শেখ হাসিনা : লেখক ও চিন্তক

অভীক ওসমান | বুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

১. শেখ হাসিনা। এই শ্যামল জনপদে দশটি নারীর নামের মধ্যে ৭ জনের নাম হাসিনা। আমাদের চোখের সামনে একটা চিত্রকল্প ভেসে উঠে বিকেলের পড়ন্ত বেলায় ডুরে শাড়ি পরে থৈ থৈ করে হাঁস, মুরগি ঘরে ঢোকাচ্ছে যে নারী তাঁর নাম হাসিনা। পিতা-মাতা ভাইয়ের স্নেহের সযত্ন পরিচর্যায়রত যে নারী তাঁর নাম হাসিনা। এইভাবে শেখ হাসিনা প্রতিকায়িত হয়েছেন বাঙালি নারীর চিরন্তন শাশ্বত রূপে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বিরাট রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে বড় হয়ে উঠলেও তাঁর রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না। একাত্তর পরবর্তী পঁচাত্তরের সৃষ্ট আরেক রক্তাক্ত প্রান্তরে গ্রিক বা শেক্সপারিয়ান ট্রাজেডির চরিত্র হিসেবে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। একদিকে রাজনৈতিক অভিঘাত ও সমান্তরালে ক্ষমতায় থাকা নিরন্তর সংগ্রাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রীকে কলম ধরার সুযোগ এনে দিয়েছে। শেখ হাসিনার ভাষায় : বই পড়ার অভ্যাস আমার শৈশব-কৈশোর থেকে এবং সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করায় আমি এ-ভুবনে একজন মুগ্ধ অনুরাগী শুধু। কোনো দিন নিজে লিখব একথা ভাবিনি। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আমার। পিতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। একদিন যে ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর যাবৎ জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি। আমার এই দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি অভিজ্ঞতা ও ভিশনকে সামনে রেখেই এই লেখাগুলো তৈরি করেছি। (শেখ হাসিনা)
শেখ মুজিবের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা বিশ শতকের আশির দশক থেকে সক্রিয় রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখি করে যাচ্ছেন। তাঁর লেখার বিষয় কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ হাসিনা যেমন খোলামেলা ও বলিষ্ঠ, লেখালেখিতেও তেমনি উন্মুক্ত। শেখ হাসিনা যখন বক্তৃতা করেন, তখন যেমন তিনি রেখে ঢেকে নিজেকে প্রকাশ করেন না। কোনো কূটকৌশলের ধার ধারেন না তিনি। কঠিন কথাও তিনি সহজে বলেন এবং লিখে যান। এটা তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ।
২. দেশে-বিদেশে পূর্বসূরিদের কথা:
পৃথিবীর সব ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনায়কই মূলত লেখক, দার্শনিক বা চিন্তক; তা না হলে তিনি শুধুই রাজনীতিক মাত্র। ফলে সংস্কৃতিমনস্কতা তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, রাষ্ট্রদর্শন ও মানবিকতার আদর্শগত তাত্ত্বিকতায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, তাঁর লেখক-বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়ক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিকিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, ইংল্যান্ডের উইনষ্টন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ইন্দ্রিরা গান্ধীর ‘মাই টু্রথ’ বা সেনেগালের লিওপল্ড সেদর সেংঘর বা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর, ‘ডটার অব দি ইস্ট’ তাঁরা সবাই-ই খ্যাতকীর্তি রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মানবতাবাদী লেখক-দার্শনিক এবং সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ও ইতিহাস-ব্যাখ্যাতা। অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়, আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁদের ধারায় নিজেকে বিন্যস্ত করেছিলেন। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারে রোজনামচা (২০১৭) ও নয়াচীন শিরোনামের প্রকাশিতব্য ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও আগরতলা মামলার বিবরণসমৃদ্ধ রচনা। এই লেখালেখির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখের মতো ভিন্নতর উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। (শামসুজ্জামান খান, ২০১৮)
আমাদের এ অঞ্চলে অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলায়, দেশবিভাগ পরবর্তী পূর্ব বাংলায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ বসু, কমরেড ভবানী সেন, কমরেড মুজাফফর আহমদ, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, মণি সিংহ, শেখ আবদুল আজিজ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নেতাদের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ ‘মোস্তফা-চরিত’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
৩. শেখ হাসিনার গ্রন্থ সমূহের মূল্যায়ন :
ওরা টোকাই কেন (১৯৮৯), বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম (১৯৯৩), দারিদ্র্য দূরীকরণ : কিছু চিন্তাভাবনা (১৯৯৫), বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন (১৯৯৯) এবং বিপন্ন গণতন্ত্র, লাঞ্ছিত মানবতা (২০০২)।
জননেত্রী শেখ হাসিনার বইয়ের নামের তালিকাটি তাৎপর্যপূর্ণ। ওই তালিকার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে বর্তমান বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক অবস্থাও নজর করা যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সিকি শতাব্দীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রায় ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে স্বাধীন হওয়া একটি বিধ্বস্ত, হতদরিদ্র দেশে পরাধীন আমলের মতোই পথশিশু বা টোকাইদের দেখে একজন দেশপ্রেমিক ও বিবেকবান রাজনীতিকের মনে এমন প্রশ্ন জাগাই তো স্বাভাবিক যে: ‘ওরা টোকাই কেন?’ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন দেশে দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে মুক্তি এখনো আসেনি। আসেনি যে তার কারণ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসী সামরিক ও ছদ্ম-সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দীর্ঘকালের জন্য ক্ষমতার মসনদে জেঁকে বসা। জনগণের নন্দিত নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের নামকরণেরই সেই জায়গাটা যথাযথভাবেই চিহ্নিত করেছেন- ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাড়ে তিন বছরের মাথায় সারাজীবনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় যিনি দক্ষিণ এশিয়ার একটি পশ্চাৎপদ ভুখণ্ডে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জন-গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তাঁকে বিদেশী সহায়তাপুষ্ট ষড়যন্ত্রকারী একটি সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারী চক্র নিমর্মভাবে সপরিবারে হত্যা করে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে একটি পশ্চাৎপদ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র নির্ভর ও ধর্মপ্রবণ রাষ্ট্রে পরিণত করে। সামরিক ও ছদ্মুসামরিক স্বৈরতন্ত্রের এই জটিল, কুটিল ও বিধ্বংসী চক্রান্তের মধ্যেও জনগণের নেত্রী বলেই লেখিকার চিন্তায় থাকে বিপুল বিশাল হতদরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের সমস্যা। তাই তৃতীয় বইটিই তিনি লেখেন ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা’ নামে। এরপর তিনি ভাবেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সামগ্রিক সমস্যা নিয়ে। বইয়ের নামও সেভাবেই নির্ধারিত হয়। গণতন্ত্র বিপন্ন হলে বিপুল মানুষের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? তাই তাঁর চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয় বিপন্ন গণতন্ত্রকে রক্ষা এবং মানবতার লাঞ্ছনা দূর করতে। এভাবে দেখলে শেখ হাসিনার রচনাসমগ্রে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও তার বাস্তবায়নে তাঁর রাজনৈতিক কৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা লেখা শুরু করেছেন তাঁর গ্রাম জীবনের বাল্যস্মৃতিনির্ভর এক স্মৃতিকাতর রচনা, ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ দিয়ে। রচনাটির ভাষা অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং ভঙ্গিটি আন্তরিক হওয়ায় প্রথমেই তা পাঠককে আকৃষ্ট করে। রচনাটির অন্য গুরুত্ব হলো লেখকের বেড়ে ওঠা ও তাঁর মানস গঠনের পরিপার্শ্ব ও গ্রামীণ আবহের নিখুঁত চিত্রায়ণ এতে বিধৃত হয়েছে। শেখ হাসিনা লিখেছেন :
আশ্বিনের এক সোনালি রোদ্দুর ছড়ানো দুপুরে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে আমার জন্ম। আমার শৈশবের স্বপ্নরঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষায় কাদা পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাকজ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে, তাল তমালের ঝোপে বৈচি, দীঘির শাপলা আর শিউলি বকুল কুড়ি মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।
বাংলা ও বাঙালি জীবনের কত গহীন ভেতর থেকে তিনি উঠে এসেছেন উপর্যুক্ত রচনাংশে তার পরিচয় চিহ্ন মুদ্রিত হয়েছে।
ওরা টোকাই কেন বইয়ের অন্য রচনাগুলো হলো: বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় কর্মকার স্বার্থে, বন্যা দুর্গত মানুষের সঙ্গে, নূর হোসেন এবং ওরা টোকাই কেন। বাংলাদেশের বিগত শতকের আশির দশকের রাজনীতি বোঝার জন্য এর প্রতিটি রচনাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম বইয়ের নাম প্রবন্ধটি এরই পরিপূরক রচনা। শেখ মুজিব আমার পিতা রচনাটির আলাদা গুরুত্ব শেখ হাসিনার পিতৃমূল্যায়নের জন্য। শেখ হাসিনা ১৯৮০র দশকে (১৯৮১) বাংলাদেশের রাজনীতির এক জটিল কুটিল ও ভয়ংকর ত্রাসমূলক ফ্যাসিস্ট সামরিকতন্ত্র ও তাদের আজীবন সঙ্গী ধর্মব্যবসায়ী, মিথ্যাচারী ও সুবিধাবাদী রাজনীতির আবতের মধ্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সিভিল সুশাসনের ঝাণ্ডা হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবির্ভুত হন। গৃহবধূ হলেও রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শেখ হাসিনা পূর্ব বাংলার বাঙালির দীর্ঘ গণসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তার স্বকীয় রাষ্ট্র সত্তায় ফিরিয়ে আনার জন্য যে সাহস, সৌর্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও বারংবার সামরিক অভ্যুত্থান কবজামুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে তা এক অধ্যায়ের সংযোজন ঘটিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক পন্থা ও বিপ্লবী ধারার এক স্বকীয় কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াসেও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও বিপ্লবী পন্থার সমন্বয় লক্ষ্য করি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতির মধ্যে এই মৌলিক সাজুয্যের উপাদানগুলোর ভেতরে একটা জায়গায় মিল লক্ষ্য করি, সেটি হল সাহস। বঙ্গবন্ধুর সেই অসীম সাহসের কিছুটা শেখ হাসিনাও উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন।
উদাহরণ হিসাবে ১৯৮৭ সালে ঢাকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের যে অগ্নিঝরা মিছিলে নূর হোসেন শহীদ হন সেই মিছিলের একেবারে ভেতর থেকে নেতৃত্বে দেয়া শেখ হাসিনার অসীম সাহস এবং ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও মিছিলে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে যে গণহত্যা চালানো হয় তার উল্লেখ করা যায়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টে ঢাকায় তাঁর সমাবেশে গ্রেনেড হামলাও ফ্যাসিস্ট খুনি চক্রের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতারই উদাহরণ। বাংলাদেশের মৌল রাষ্ট্রসত্তা ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের এইসব ভয়ংকর হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যেও শেখ হাসিনা তাঁর রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন অকুতোভয়ে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশবাসীর কল্যাণের জন্য প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে থেকেও এমন অঙ্গীকারাদীপ্ত রাজনৈতিক সংগ্রামের নজির বিরল।
শেখ হাসিনার সমাজ ও অর্থনৈতিক চিন্তার পরিচয় বিধৃত হয়েছে তাঁর দুটি বই : দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তা ভাবনা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন এ তিনি এ সম্বন্ধে বলছেন: ‘দারিদ্র্য যেহেতু বহুমাত্রিক একটি সমস্যা, সেহেতু শুধুমাত্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় এবং কর্মসংস্থান বাড়ালেই চলবে না, তার খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা স্বাস্থ্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়াতে হবে তার অধিকার সচেতনতা, তার সংগঠন করার ক্ষমতা, স্থানীয় পর্যায়ে স্বশাস্তি সরকারের কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণের মাত্রা (দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা) উপর্যুক্ত বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখাটিতে তিনি এ বিষয়ের আরো বিস্তৃত বিশ্লেষ্ট এবং আনুষঙ্গিক করণীয়ের ওপরও আলোকপাত করেছেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে সমাজকে যেভাবে নির্জীব করে ফেলা হচ্ছে তাতে সমাজের নিজস্ব উদ্যোগ, সংগঠন ও উদ্ভাবনী শক্তিই হারিয়ে যাচ্ছে। এ পথে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব নয় বলেই তাঁর বিশ্বাস।
বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন শীর্ষক বইয়ের মূল লেখাটি বিশদ বা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ বা কৌশলগত বিশ্লেষণমূলক নয়; তবে এতে নীতিগত বিবেচনাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ভোটে জিতে ক্ষমতার মসনদে আরোহণের জন্যে রাজনৈতিক ইস্যুকে বাগড়ম্বরপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করে কেমন করে সরকারের পতন ঘটানো যায় সেই লক্ষে পরিকল্পিত। শেখ হাসিনা বলছেন : ‘রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।’ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা হবে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে। কে কত ভালো কর্মসূচি দিতে পারে। কোন দলের কর্মসূচি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে বেশি ফলপ্রসূ জনগণ তা বিচার করার সুযোগ পাবে। আন্দোলন হবে সমাজ সংস্কারের জন্যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। আর এ উন্নয়ন মুষ্টিমেয় মানুষের জন্যে নয়। এ উন্নয়ন হতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য। সমাজের অধিকাংশ মানুষ যারা বঞ্চিত, জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে না: শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে; বঞ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। এই সম্পদ কেউ যদি বেশি পরিমাণে দখল করে তাহলে অন্য কেউ বঞ্চিত হয়। কাজেই সম্পদের সুষম বণ্টন প্রয়োজন। (বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন) শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনা ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চিন্তাকে বুঝে নেয়ার জন্যে তাঁর ‘শিক্ষিত জনশক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত’ এবং ‘গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু কথা’ শীর্ষক লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন, সমাজ-ভাবনা ও মানবিকবোধ ও সংবেদনশীলতার পূর্ণ পরিচয়ের জন্য অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির অন্বেষায় অবশ্যই পাঠ্য। সেই সঙ্গে পাঠককে যত্নের সঙ্গে ‘ও আলোর পথযাত্রী’ রচনাটি পাঠ করতে অনুরোধ করবো। স্বাধীনতার মর্মবাণী ও সংস্কৃতিবোধের গভীরতর প্রকাশে এ লেখাটি হৃদয়কে স্পর্শ করে।
‘বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা’ নামের বইয়ের শেষ দুটি লেখায় ১৯৯৬-২০০১ সালে তাঁর সরকার গণতান্ত্রিক ধারা ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যে প্রয়াস চালান এবং তাতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে ২০০১ সালের কারচুপি, ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী পন্থায় বি.এন.পির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সহিংস নির্যাতন, লুটপাট, নারী ধর্ষণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিনাশী আক্রমণ চালিয়ে কীভাবে গণতন্ত্রকে বিপন্ন, বিপর্যস্ত এবং মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয় তার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। এছাড়াও গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেশের প্রচলিত আইনে করার যে সিদ্ধান্ত তাঁর সরকার নেয় সে বিষয়ের উপস্থাপনা, গত কয়েক দশকের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতিসহ প্রায় সকল বিষয়েরই উল্লেখ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্লেষণও আছে লেখা দুটোতেই। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মরণে : ‘আমাদের চেতনায় অগ্নিশিখা’ লেখাটিও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। (সম্পাদনায় : শামসুজ্জামান খান)
৪. নির্বাচিত প্রবন্ধ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ এ গ্রন্থে এমিরিটার্স প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, লেখক হিসেবে শেখ হাসিনা মূলত প্রাবন্ধিক বিশেষভাবে বলতে গেলে রাজনৈতিক ভাষ্যকার। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে সংকলিত দশটি প্রবন্ধ : ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী’, ‘ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড’, ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ (এক, দুই), ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’, ‘ড. আবদুল মতিন চৌধুরী : আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম’, ‘বেগম জাহানারা ইমাম’, ‘নূর হোসেন’ এবং ‘একানব্বইয়ের ডায়েরি’। এর আগে শেখ হাসিনার অন্তত দশটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ এবং যৌথ সম্পাদনায় দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও যে শেখ হাসিনার লেখনী কখনও থেমে থাকেনি তাঁর প্রমাণ আলোচ্য ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ সংকলনটি। এই সংকলনে বিভিন্ন সময়ে লিখিত ও প্রকাশিত নির্বাচিত তেরোটি প্রবন্ধ রয়েছে।
৫. শেখ হাসিনার ভাষণ, জীবন ও কর্মের উপর সংকলন ও সম্পাদনা :
শেখ হাসিনার মৌলিক লেখা ছাড়াও বিশিষ্ট সংস্কৃতি সংগঠক ও সাংসদ পান্না কায়সার ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’ শীর্ষক জাতীয় সংসদে [১৯৮৭-১৯৯৪] জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রদত্ত ভাষণের একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। (নভেম্বর ১৯৯৮) ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভাষণের একটি অংশ সংসদে বসেছেন কেবল তাঁরাই পারেন এই সংশোধনী পাশ করতে।
সামরিক শাসনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হলো রাজনীতিতে অস্ত্রের আমদানি। সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭):
আজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এখনই সিদ্ধান্ত নিন, জাতীয় জীবন থেকে অস্ত্রের খেলা বন্ধ করুন; অস্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের খেলা বন্ধ করুন; এই সেনাবাহিনীকে ব্যারাকেই থাকতে দিন; ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে তাঁদেরকে ব্যবহার করবেন না। আসুন, এই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে তাঁদের কাজ করতে দিন। তাঁদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করবেন না। তাহলেই শিক্ষাঙ্গণ অস্ত্রমুক্ত হবে। (সম্পাদনায় -আনিসুজ্জামান)
রবীন্দ্রনাথের জীবনীকা হিসেবে প্রথমেই প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম আসে। ইন্দ্রিরা গান্ধীর জীবনীকার হিসেবে তার পুপুল জয়কার নাম বিখ্যাত। অনুরূপভাবে শেখ হাসিনার বান্ধবী বেবি মওদুদের নামও উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ’ (ফেব্রুয়ারি ২০০১ সম্পাদনা করেন)।
তাছাড়া তিনি শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা’ নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। (বইমেলা ২০১১) এই বইয়ের ভূমিকায় আবদুল গাফফার চৌধুরী হাসিনার নেতৃত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ডেমোক্রেটিক জোন অব পিস’
৬. আমরা মনে করি এস ইন্ডিভিজুয়েল লিডার শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অত্যন্ত কারিশমেটিক। কারণ তাঁর সাহস ও স্বপ্ন দুটিই আছে। এই সাহসিকা রাষ্ট্রজন জানেন সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়ার হারাবার কিছু নেই। পঁচাত্তর তাকে সর্বহারা করেছে। করেছে সাহসিকতা রাষ্ট্রজন। অনুরূপভাবে তাঁর লেখায় আবেগঘন নষ্টালজিয়া, জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন প্রতিফলিত হয়েছে। তাই তাঁর সব লেখায় জনগণকে অবশ্যই পড়তে হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যজন

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ কথা কে বিশ্বাস করবে আজ
পরবর্তী নিবন্ধবাঙালির সংশপ্তক