বাঙালির সংশপ্তক

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | বুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

জীবন সঁপিয়া, জীবনেশ্বর
পেতে হবে তব পরিচয়,
তোমার ডঙ্কা হবে যে বাজাতে
সকল শঙ্কা করি জয়।
কবিগুরুর এই অমিয় বাণীর আলোকে বলা যায় ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ প্রতিপন্ন করে ৭৬ বছরেও বাঙালির নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। বাঙালির জীবনে হাজার বছরের পুণ্যের ফল যদি হয়, এ জাতির মাঝে বঙ্গবন্ধুর অভ্যুদয়, বলা যায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আমাদের জন্যে স্রষ্টার আশীর্বাদ। বর্তমানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাঁর নেতৃত্ব সত্য, অনিবার্য। কিন্তু কেন ? এমন করাল করোনাকালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের উপরে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটি খাতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চার-চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, দেশের দীর্ঘতম সরকার প্রধান। মানবতা ও মুক্তির প্রতীক তিনি। জীবনের অর্ধাংশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী শেখ হাসিনা। ৭৫ পরবর্তী পিছিয়ে পড়া জাতিকে অগ্রগামিতার সুবর্ণ বন্দরে পৌঁছে দেয়ার মহান ব্রতে তাঁর চেষ্টা অবিরাম ৭৬তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ২১ বছরের পিছিয়ে পড়া দেশকে পুনর্জাগরিত করেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়, পরিশ্রম ও ইবাদত তাঁর এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র।
দেশের শক্তিশালী অর্থনীতি, সামর্থ্য ও আত্মমর্যাদার জাজ্বল্যমান প্রমাণ মেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, সমুদ্রসীমা বিজয়, কর্ণফুলীর তলদেশে অচিরেই উদ্বোধন হতে যাওয়া বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চলমান মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাস্তবায়নাধীন এশিয়ান হাইওয়ে রোড প্রকল্প, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি এক মহা কর্মযজ্ঞ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বহুবার মৃত্যু-দুয়ার থেকে ফিরে আসা ও জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করে শেখ হাসিনা এখন সোনার বাংলার খাঁটি সোনা।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মেধা-মনন, সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং উদার-মুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ খোলনলচে পাল্টে গেছে। সৎ ও কর্মঠের তালিকায় বিশ্বের সেরা তিনে স্থান করে নিয়েছেন তিনি।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। মাঝখানে ১ মেয়াদ পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে ২০০৯ সালে আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট পায়। এই ধারাক্রমে যদি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে সামিল হবে।
উন্নয়ন ও অগ্রগতি শব্দের সমার্থক শেখ হাসিনা। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ইনকু্লসিভ ইকোনোমিক ইনডেক্স অনুযায়ী অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিলো ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার। শেখ হাসিনার শাসনামলে মাথাপিছু আয় বেড়ে প্রায় ৩ হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি পেতে হলে যেখানে মানবসম্পদ সূচক ৬৬ ভাগ প্রয়োজন, সেখানে শেখ হাসিনার আমলে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা মানেই এক সংগ্রামের জয়গাথা। তাঁর এই অর্জন কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। পদে পদে পেয়েছেন বাধা। তাঁর জীবনের ওপর হামলা হয়েছে ২১ বার। কিন্তু অকুতোভয় নেত্রী সকল ভ্রুকুটি, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বাংলা বাঙালির জন্য আলোকিত স্বর্ণোজ্জ্বল সময় ও সমৃদ্ধি এনে দেওয়ার ব্রতে সংশপ্তক যোদ্ধার মতো লড়ে যাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় তুলে এনেছেন। বাংলাদেশ আজ “ইমার্জিং টাইগার’’। প্রসঙ্গত, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি ম্যাক্স বলেছেন, “পৃথিবীর দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের অগ্রগতি বিশ্লেষণ করলে, যা প্রতিবছর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক করে থাকে, ২০১৫ থেকে, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশ বেশিরভাগ অগ্রগতিতে বিশ্বে প্রথম হয়েছে।” এ-তো চাট্টিখানি কথা নয়। কোন যাদুস্পর্শে এই অভাবনীয় পরিবর্তন! সেই আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ হাতে আছে শেখ হাসিনার। তাঁরই অতুলনীয় নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই বিশাল অর্জন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অনন্য উচ্চতা, মহাসম্মান। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়ও বঙ্গবন্ধু কন্যার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফোবর্সসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। অসহায়-নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা “মাদার অব হিউম্যানিটি” খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার আর একটি অনন্য কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থসমূহ অসমাপ্ত আত্নজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর এসব দুর্মূল্য রচনাবলী প্রকাশ একটি বিস্ময়কর ঘটনা বলা যায়। আর এর জন্যে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভূমিকা, অবদান ও নিষ্ঠা ভাবীকালে ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার জীবন-বৃত্তান্ত থেকে জানা, যায় তিনি ২৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে – ১. Democracy in Distress Demeaned Humanities ২. সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র: (Militarism Verses Democracy) ৩. শেখ রাসেল(Shekh Rasel) ৪. শেখ মুজিব আমার পিতা ৫. দারিদ্র দূরীকরণে কিছু চিন্তা-ভাবনা উল্লেখযোগ্য।
শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দেশ আজ শনৈঃ শনৈঃ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য জাতীয় সংসদের আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রয়োজন অপরিহার্য। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থেই এই উন্নয়নের ধারা চলমান রাখা জরুরি। কেননা এখন শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে মৃত্যুর পর পিতার আরাধ্য স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক।
২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর ৭৬ তম জন্মদিনে কারমনোবাক্যে এই-ই হোক প্রার্থনা। জয়তু শেখ হাসিনা। তিনি শতায়ু হোন। জয় বাংলা।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনা : লেখক ও চিন্তক
পরবর্তী নিবন্ধ‘জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছো দান’