শুভ জন্মদিন, সেলিনা হোসেন

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১৯ জুন, ২০২১ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

যে-অর্থে বিভাজিত হয় লেখক ও লেখিকা সেই সীমানা প্রাচীর ভেঙে বহুদূর এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় লেখক সেলিনা হোসেন। ৫৫ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্বগর্ভ বিচরণ। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে উপন্যাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন পাঠকের হৃদয়ে। আমাদের গৌরবদীপ্ত অর্জন ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের অধিকার, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক চেতনা তাঁর লেখার বিষয়। তাঁর রচনার মূল সুরই হচ্ছে সমাজ ও মানুষের কল্যাণ। তিনি বিশ্বাস করেন সাহিত্য ক্ষমতায়নের জায়গা নয়। সাহিত্য সৃজনশীলতার জায়গা। সৃজনশীলতা শক্তির নিজস্ব বিকাশ। এখানে তিনি নারী ও পুরুষের ভেদ দেখেন না। সাহিত্যে তিনি নারী পুরুষের ভেদ না দেখলেও সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। নারীর অধিকার, নারীমুক্তি প্রগতি, নারী পুরুষের সম্পর্ক এসব বিষয় নিয়ে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমার প্রথম চিন্তাটি হলো নারীকে নিজের শক্তিতে তৈরি হতে হবে। নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনতে হবে নারীকেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে সংস্কারের চার দেওয়ালের ভেতর বন্দী রাখার নানাবিধ উপায় খোঁজে।’
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো সবসময় প্রতিবাদী হয়। তিনি মনে করেন প্রতিবাদ মানুষের কণ্ঠস্বর। জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হতে হয়। যে ব্যক্তি নতজানু মনোভাব নিয়ে দিন যাপন করে সে তার ব্যক্তিত্বকে হারায়। তাঁর লেখায় বাঙালি জাতিসত্তার পরিচিতি বারবার স্পষ্ট হয়েছে। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে প্রজন্মকে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের ঘটনা সাহিত্যের মাধ্যমেই উত্তরাধিকারীরা জানতে পারে। প্রত্যেক দেশের মানুষই শিল্প মাধ্যমেই নিজেদের জাতিসত্তার আইডেনটিটি খুঁজে পেতে চায়। তাই তাঁর উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্য নানামুখী করে তুলেছেন ‘যাপিত জীবন’ ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর পূর্ণ ‘ছবির মগ্নতা’। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভূ-খণ্ডে যে কয় বছর বাস করেছিলেন সেই পটভূমিতেই লিখেছিলেন, পূর্ণ ছবির মগ্নতা। এই উপন্যাসে তিনি দেখাতে চেয়েছেন এখানকার পূর্ববঙ্গের নদী ও দরিদ্র মানুষের জীবন। আমাদের ভূখণ্ডে না আসলে কবি জনজীবন দেখার সুযোগ পেতেন না। হৃদয় জোড়া প্রকৃতিও হয়তো দেখা হতো না। তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।
তারপর উপন্যাস, গল্প, শিশু সাহিত্য প্রবন্ধ ভ্রমণ কাহিনীসহ লেখালেখির নানা ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করে যাচ্ছেন। তাঁর লেখার বিষয় বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয় সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটও। বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। নির্ভীক তাঁর কন্ঠ সাহিত্য ও প্রবন্ধে। ১৯৮০ সালে জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক এবং ২০১০ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন। তাঁর দশটি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এছাড়া বহু সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেন লেখক। বাংলা একাডেমীর চৌত্রিশ (৩৪) বছর কাজ করার পর ২০০৪ সালে পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ও শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান ছিলেন। পশ্চিম বঙ্গের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘যাপিত জীবন’ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ উপন্যাস পাঠ্যসূচিভুক্ত। এছাড়া আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পাঁচটি উপন্যাস এম ফিলভুক্ত হয়। শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য কোর্সে তাঁর ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি পাঠ্যসূচি ভুক্ত হয়। তিনি ছিট মহল নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস ‘ভূমি ও কুসুম’ রচনা করেন। সেলিনা হোসেন মা, মাটি ও মানুষ হৃদয়ে ধারণ করে বাংলা ভাষাকে যেমন ঋদ্ধ করেছেন তারচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছেন পাঠকের হৃদয়।
১৪ জুন তিনি পঁচাত্তরে (৭৫) পা রাখলেন। অভিনন্দন বাংলা ভাষার এই নন্দিত লেখককে। তাঁর পরিবারের আধুনিক দৃষ্টিভংগীর কারণে নারী লেখক হিসেবে তাঁকে কখনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। তাঁর স্বামী আনোয়ার হোসেন বরাবরই তাঁর পাশে ছিলেন নির্দ্বিধায় তিনি তা স্বীকার করেন। এই কীর্তিমান লেখকের সাথে আমার দুইবার দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁর অসাধারণ সুন্দর হাসির মতো কথা বলার ভংগীটাও কি চমৎকার। কি আশ্চর্য আন্তরিকতার কাছে টেনে নেন একজন পাঠককেও মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমাদের ভালবাসায়, শ্রদ্ধায় আরও বহুদিন বেঁচে থাকুন সুস্থতায়। আপনার কলমে আরও সহস্র ফুল ফুটুক। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আপনার জন্মদিনে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসহিংসতা ভাষা প্রয়োগে
পরবর্তী নিবন্ধউপকূল সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সচেতনতামূলক সভা