শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন

রেজাউল করিম | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ

মাঘের শীতে নাকি বাঘও পালিয়ে বেড়ায়। ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই শীতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাঙালির জীবনে প্রকৃতিতে শীত আসে সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ নিয়ে। ‘কন্‌কনে শীত তাই/ চাই তার দস্তানা/ বাজার ঘুরিয়ে দেখে/ জিনিসটা সস্তা না/ কম দামে কিনে মোজা/ বাড়ি ফিরে গেল সোজা/ কিছুতে ঢোকে না হাতে/ তাই শেষে পস্তানা।’ (কন্‌কনে শীত তাই : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

শেলীর কবিতার একটি পঙক্তি ‘ইফ উইন্টার কাম্‌স ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড’ (শীত যদি এসেই যায় ফাগুন তো দূরে নেই)। শীতের আগমনী ঘটে পৌষ দিয়ে। এবারে শীত জেঁকে বসেছে। অনেক জেলায় স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। আর প্রাথমিক স্কুলগলোয় ক্লাস শুরু হবে সকাল ১০টায়। শীতকাবু মানুষের কাহিল হয়ে জবুথবু অবস্থা। বিজ্ঞানীদের কথাগুলো ভীতিকর করে দিচ্ছে। শীতের আবার প্রীতিকর দিক রয়েছে। যেমন শীতের পিঠাপুলি। খেজুর গুড়। পিকনিক। গরম কাপড়ে ফিটবাবু হয়ে থাকা। শীতের ঘন কুয়াশা ও শিশিরের মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকার পথচলার পালা চলতে থাকবে। গ্রামীণ জীবনে আঙিনায় চুলার ধারে বসে তাপ নেওয়া। সকালে সন্ধ্যায় খরকুটা জ্বালিয়ে উষ্ণতা নেওয়া। শরীরে চাদর আবৃত করে মুখ ঢেকে পথচলা। সন্ধ্যারাতেই ঘরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমানো। শীতের রাতে শহুরে জীবনেও লোকজন তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে মানবজীবনে চলার পথকে এগিয়ে দিতে নানা প্রতিকূলতা নিয়ে আসে। কত কবিসাহিত্যিক কত কিছুই না বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসে টেনে এনেছেন প্রকৃতি। বিশ্বের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলুলয়েডের ফিতায় বিভূতিভূষণকে বন্দি করেছেন। শীতের বর্ণনায় সেঙপিয়র বলেছেন ‘হে শীতের বাতাস, তোমার কনকনে শীতের দংশন অত নিষ্ঠুর নয় যত নিষ্ঠুর মানুষের নির্মমতা ও অকৃতজ্ঞতা।’

বাঙালির শীতের সংস্কৃতিতে আসে পিঠাপুলি। কত বাহারি পিঠাই না বানানো হয় বাঙালির ঘরে। পিঠার যে কত নাম। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটায় পিঠা তৈরিতে। এ সময় খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠাপায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে। সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা। এছাড়াও আছে চিতই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা ইত্যাদি। বাংলাদেশে শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে।

একসময় এ দেশে যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা! পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য। পিঠাপায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনো অসংখ্য গান, কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’

এই মৌসুমেই গ্রামের পথেপ্রান্তরে নজর কেড়ে নেয় হলুদ বরণ ফুলের শর্ষে খেত। মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের পালা শুরু হয়। শীত গরিবের জন্য অশান্তি, আর কিছু ধনীর জন্য প্রশান্তি নিয়ে আসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় কৃষিজমির টপসয়েল কাটায় ২ লাখ টাকা জরিমানা