শাসন করতে গিয়ে মায়ের মারধরে ছেলের মৃত্যু

পরে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা মা ও মামা গ্রেপ্তার

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১১ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

মামা নুরনবী ইসলাম সোহেলের পকেট থেকে টাকা চুরির অপরাধে ছেলে হাছানকে (১৪) শাসন করতে গিয়ে মারধর করেন মা কুলসুম। শাসনের একপর্যায়ে ছেলেকে ধাক্কা দিলে সে পড়ে যায় এবং খাটের লোহার পায়ার সাথে লেগে মাথার পেছনের অংশে আঘাত পায়। রক্তক্ষরণ হতে থাকে অনবরত। ভয় পেয়ে যান কুলসুম। ডাকেন তার ভাই ফারুককে। দুজন মিলে হত্যাকান্ডটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর নাটক মঞ্চস্থ করেন। কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়ালী উদ্দিন আকবর ঘটনাস্থলে গিয়ে ঠিকই বুঝে নেন, এটি হত্যাকান্ড; কিছুতেই আত্মহত্যা হতে পারে না। গত সোমবার রাতে নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মো. হাছান (১৪) নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন ওয়ারলেস কলোনি এলাকার বাসিন্দা বেলাল হোসেনের (৪২) ছেলে। তাদের বাড়ি মাগুরা জেলায়। গ্রেপ্তার দুজন হলো হাছানের মা কুলসুম বেগম (৩৮) ও মামা ফারুক ইসলাম (২৪)। মঙ্গলবার কুলসুম ও ফারুককে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। কুলসুম হত্যাকান্ড এবং পরবর্তী ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত দুজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর আজাদীকে বলেন, আমাদের কাছে প্রথম খবর আসে যে এটা সুইসাইড কেইস। রাত দুইটার দিকে আমি স্পটে যাই। প্রথমেই যে মহিলা দা দিয়ে ওড়না কেটে লাশ নামিয়েছিল তার সাথে কথা বলি। তিনি জানান, কুলসুম আর তার ভাইয়ের চিৎকার শুনে ছুটে আসেন তারা সবাই। হাছান বাসার চালের ভেন্টিলেটরে লোহার রডের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে শুনি। ওড়না কাটার সিদ্ধান্ত নিই সবাই মিলে। কিন্তু কুলসুম ঘরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। পরে আমি বাইরের দিকে ভেন্টিলেটর ফাঁক দিয়ে অনেক কষ্টে ওড়না কেটে হাছানকে নামাই।
ওসি বলেন, এ কথা শুনে আমার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়। ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। আত্মহত্যা করলে কিছু সিম্পটম থাকে। কিন্তু সেরকম কিছু পাইনি। উল্টো হাছানের মুখ দিয়ে ফেনা ও পানি বেরুচ্ছিল। আত্মহত্যা করলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। তৃতীয় বিষয় হলো, তার আঘাতটা ছিল শুধু মাথার পেছনে। বুঝতে বাকি রইলো না এটা যে আত্মহত্যা নয়। প্রাথমিক তদন্তে আমরা এটা নিশ্চিত হয়েছি যে, এটা কোনো পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকান্ড নয়। শাসন করতে গিয়ে প্রচন্ড ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মারধর করতে গিয়ে মা ছেলেকে অনাকাঙ্খিত ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। মায়ের আঘাতেই ছেলের মৃত্যু হয়েছে এবং পরবর্তীতে সেটাকে আত্মহত্যা বলে আড়াল করার চেষ্টা করে আরও অপরাধ সংঘটিত করেছেন। একজন মায়ের হাতে ছেলের মৃত্যুর ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হাছানের বাবা বেলালের দুই স্ত্রী। পারিবারিক কলহের কারণে বাবা-মা আলাদা থাকায় হাছান তার মায়ের সঙ্গে বিশ্ব কলোনির আল হেরা মসজিদ গলির ‘জে’ ব্লকের একটি বাসায় থাকত। তার মামা ফারুক থাকতেন ‘আই’ ব্লকের একটি বাসায়।
বেলাল হোসেন জানান, তার ছেলে হাছান নগরীর চার নম্বর রুটের বাসের চালকের সহকারী হিসেবে একসময় চাকরি করত। কিন্তু বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা চুরির অভিযোগে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর কুলসুম তাকে দৈনিক ১৫০ টাকা বেতনে হাটহাজারী উপজেলায় তার বাবার কুলিং কর্নারে চাকরি নিয়ে দেন।
বেলাল বলেন, গত মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে কুলসুমের ভাই ফারুক বাসায় গিয়ে জানায়, ছেলে হাছান গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর পেয়ে বেলাল দ্রুত কুলসুমের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। এর আগেই স্থানীয় লোকজন বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করে। আকবর শাহ থানা পুলিশ ঘটনা তদন্তে নামে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কুলসুম হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন।
কুলসুম জানান, গত রোববার হাছান কুলিং কর্নারে তার মামা নুরনবী ইসলাম সোহেলের মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা চুরি করে পালিয়ে শহরে মায়ের বাসায় চলে আসে। সোহেল বিষয়টি কুলসুমকে জানানোর পর তিনি ক্ষুব্ধ হন। সোমবার রাত ১১টার দিকে ছেলেকে শাসন করতে গিয়ে বেদমভাবে মারধর করেন। মারধরের একপর্যায়ে ছেলেকে ধাক্কা দেন। এতে হাছান ছিটকে পড়ে খাটের লোহার অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে লেগে মাথার পেছনে গুরুতর আঘাত পায়। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে হাছান। ছেলের সাড়াশব্দ না পেয়ে কুলসুম ভয় পেয়ে যান। ভয় পেয়ে কুলসুম তার ভাই ফারুককে ডেকে আনেন। তখন দুজনে খুনের বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা হিসেবে সেটাকে প্রচারের পরিকল্পনা করেন। দুজন মিলে হাছানের মৃতদেহ বাসার ভেন্টিলেটরের লোহার রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। রাত পৌনে ২টার দিকে হঠাৎ তারা বাসার বাইরে এসে চিৎকার করে কান্না শুরু করেন। প্রতিবেশি আসমা আক্তার এলে তাকে বাসার বাইরে রেখে ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে ওড়না কেটে লাশ নিচে নামায়। একজন চিকিৎসককেও ডেকে আনা হয়। তিনি এসে হাছানকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় বেলাল হোসেন বাদী হয়ে কুলসুম ও ফারুককে আসামি করে আকবর শাহ থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ কুলসুম ও ফারুককে তাদের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিইসিসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরাজিত প্রার্থী যুবলীগ নেতার মামলা
পরবর্তী নিবন্ধস্কুলের গেট ভেঙে মায়ের সামনেই শিশুটির মৃত্যু