শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ

২০১৭ সালের মার্চ, হঠাৎ করে অফিস থেকে জানালো জুলাই থেকে আমাদের প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। যেখানে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা চাকরির চুক্তি সাইন করেছি, সেখানে এমন খবরে মাথায় এক্কেবারে বাজ পড়ার মত অবস্থা। তার উপর দেশে হলে কথা ছিল, বিদেশের মাটিতে এ-এক মন খারাপ করা অবস্থা। মাত্র দেড় বছর আগে ২০১৬ এর ফেব্রুয়ারিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করার জন্য থাইল্যান্ড যাই। যাওয়ার পর ঠিক করেছিলাম অনেক-অনেক ঘুরব। আর চাকরিটাও এমন হল যে প্রতি সপ্তাহে থাইল্যান্ডের এই শহর-ওই শহর যেখানেই শরণার্থী ছিল, সেখানেই যেতে হত। ঠিক চাকরি বলে মনে হতো না, মনে হতো লম্বা ভ্রমণে বের হয়েছি সাথে বোনাস হিসেবে শরণার্থীদের সাথে কাজ করছি। তো, সেই চাকরি যখন সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে জানতে পেলাম, মন খারাপের অন্ত ছিল না। এর মাঝে এক বছরে যখনই সুযোগ পেয়েছি একা একা অনেক ঘুরেছি, আশেপাশের দুই একটি দেশে গিয়েছি। যেখানেই গেছি, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন খাবার, আর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও আমার আরেকটি আকর্ষণ ছিল সেখানকার নারীদের জীবন। যেখানেই গিয়েছি মেশার চেষ্টা করেছি সেখানকার নারীদের সাথে, জানার চেষ্টা করেছি তাদের জীবন এবং ভাবনা।
প্রজেক্ট বন্ধের অফিস নোটিশের পরেই পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম কীভাবে কম খরচে কত বেশি দেশ ভ্রমণ করা যায়। এর মাঝে অনেক ভ্রমণকারীর সাথে পরিচয়ের সুবাদে জানতে পেরেছি কীভাবে তারা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর স্বল্প খরচে ভ্রমণ করে। ঠিকঠাক করে কম খরচে ভ্রমণ করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা। প্রথমে ঠিক করতে হয় কোথায় যেতে চাই, তারপর জানতে হয় সেখানকার আর্থসামাজিক অবস্থা, থাকার ব্যবস্থা কেমন, নিরাপত্তা কেমন, অন্যান্য ভ্রমণকারীরা সেই জায়গা নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন বিভিন্ন লগ খুঁজে সেগুলো পড়া। তারপর আমার যে বিষয়ে উৎসাহ, সে-বিষয়ে সম উৎসাহী স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসুদের খুঁজে বের করা, যোগাযোগ করা যাতে মন ভরে আড্ডা দেয়া যায়। এই সবকিছুর পর ঠিক করা, কোথায় হবে আমার পরবর্তী ভ্রমণ। স্থান নির্বাচনের পর এবার শুরু হবে প্রস্তুতি, সেটি যদি অন্যদেশ হয় তাহলে রয়েছে ভিসা নেয়া, সস্তায় কীভাবে বিমানের টিকেট কাটা যায় সেটি খোঁজা, ভিসার জন্য আবার হোটেল বুকিং দেয়া, ব্যাংকে নির্দিষ্ট অংকের টাকার ব্যবস্থা করা। এবং এইসব কিছু আবার নির্ভর করত অফিসের ছুটি পাওয়ার উপর। তাই প্রকল্প বন্ধের একটা সুবিধা দেখা দিল, আমাকে ছুটি নিয়ে ভাবতে হবে না। যতদিন অর্থ সংকুলান করতে পারব, ততদিন ঘুরতে পারব।
বসে গেলাম পরিকল্পনা এবং গবেষণায়। স্বল্প খরচে যারা ভ্রমণ করে এবং স্থানীয় মানুষের সাথে মিশতে চায়, তাদের জন্য বেশ কিছু অনলাইন প্লাটফর্ম আছে মানে ওয়েবসাইট আছে, যেগুলো ভ্রমণকারী এবং স্থানীয় মানুষ যারা ভ্রমণকারীদের নিজের বাড়িতে থাকতে দিতে আগ্রহী, উভয়ের মধ্যে সংযোগের সুবিধা করে দেয়। এমন একটি ওয়েবসাইট হল ‘কাউচসার্ফিং’। এখানে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভ্রমণকারী খুঁজে নিতে পারেন স্থানীয় কাউকে যে হয়ত নিজেও ভ্রমণকারী এবং অন্য ভ্রমণকারীদের সহয়তা করতে চায়। এই ওয়েবসাইটের আরেকটি সুবিধা হল বিভিন্ন গ্রুপ, যেমন ‘সোলো উইমেন ট্রাভেলারস গ্রুপ’, একা ঘুরে বেড়ানো মেয়েদের গ্রুপ, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ভলেন্টিয়ারস গ্রুপ’ পৃথিবীজুড়ে ঘুরে-ঘুরে স্বেচ্ছাশ্রম করে বেড়ানো মানুষের গ্রুপ, এমন অসংখ্য গ্রুপ যেখানে যে-যার মতো অন্য ভ্রমণকারীদের সাথে যুক্ত হতে পারে, আলোচনা করতে পারে নিজের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে, খুঁজে নিতে পারে ভ্রমণসঙ্গী।
আগেই বলেছি যে-কোনো জায়গাতে আমার ঘুরতে যাবার পেছনে একটি আগ্রহ হল সেখানকার নারীদের জীবন দেখা। আমি সেইমত বিভিন্ন গ্রুপে কে কী করছে দেখা শুরু করি যাতে আমার বেকার সময়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে সুবিধে হয়। একদিন একটি গ্রুপে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। শরণার্থীদের সমর্থনে এবং নারীবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কয়েকজন নারী এবং পুরুষ ভ্রমণকারী এক হয়ে সেই জার্মানি থেকে ২০১৫ সালে ভ্রমণ শুরু করেছে। যাদের লক্ষ্য কোন বিমান ব্যবহার না করে স্থলপথে এবং স্থানীয়দের বাড়িতে থেকে জার্মানি থেকে ইন্ডিয়া হয়ে ভিয়েতনামে গিয়ে শেষ করা এবং চেষ্টা করা যতখানি পারা যায় বিনা খরচে ভ্রমণ করা। এর জন্য তারা থাকার জন্য ঠিক করেছে ‘কাউচসার্ফিং’এর মাধ্যমে স্থানীয় আগ্রহী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে থাকার ব্যবস্থা করা এবং ‘হিচহাইকিং’ এর মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া। এবার একটু ‘হিচহাইকিং’ নিয়ে বলি। ‘হিচহাইকিং’ হল সেই ভ্রমণের পন্থা যেটি যাযাবরেরা শত বছর ধরে ব্যবহার করেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্রমণকারীরা যে-সব গাড়ি চলাচল করে সেগুলোর চালককে অনুরোধ করে, ভ্রমণকারীকে তার গাড়িতে করে গন্তব্যে বা গন্তব্যের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছে দিতে। অনেক সময় সিনেমাতে আমরা দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতের বুড়ো আঙ্গুল উঁচিয়ে রাখে যাত্রী যাতে কেউ তাকে লিফট দেয়। এই প্র্রক্রিয়াটিই ‘হিচহাইকিং’। অনেকে নৌপথে এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে এভাবে ভ্রমণ করে একে বলে, ‘হিচসেইলিং’। তো, এরা এভাবেই পুরো পথ ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা স্থলপথে প্রায় ২৭,৭০২ কিলোমিটার ভ্রমণ করছে। আর এই ভ্রমণকালীন তারা যেখানে গেছে সেখানকার যেসব প্রতিষ্ঠান নারী এবং শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে দেখা করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের রান্নার রেসিপি সংগ্রহ করেছে যেগুলো তাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত আপডেট করেছে এবং পরিকল্পনা হল সুযোগ হলে এই নিয়ে বই প্রকাশ করবে। এই ভ্রমণ প্রকল্পটির নাম দিয়েছে তারা ‘স্পাইসিরোড’। ‘স্পাইসিরোডে’র সদস্যরা যে দেশের উপর দিয়ে যায় সেখান থেকে স্থানীয় ভ্রমণকারীদের আহ্‌বান করে তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য। তবে এই প্রক্রিয়াটি কোন অংশে চাকরির প্রক্রিয়ার চেয়ে কম নয়। বিজ্ঞাপনে তারা জানিয়েছে তারা জুনের মাঝামাঝি থাইল্যান্ডে ঢুকবে মিয়ানমার হয়ে, এই সময় থাইল্যান্ড থেকে তারা একজন নতুন সদস্য নেবে দলে যে তাদের সাথে থাইল্যান্ড থেকে ক্যাম্বডিয়া, লাওস হয়ে ভিয়েতনাম পর্যন্ত যেতে পারবে। এজন্য তারা আগ্রহীদের সিভিসহ আবেদনপত্র জমা দিতে বলেছে। এই বিজ্ঞাপন দেখে আমি চাকরি হারানোর দুঃখ বেমালুম ভুলে গেলাম।
মনে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এত কথা বলছি যেটি হয়ত কারো তেমন কোন কাজেই আসবে না। এইসব ভূমিকা দিচ্ছি একজন নারীর একা ভ্রমণের পেছনের গল্পটা বলবার জন্য, কারণ আমি আপানদের আমার লম্বা ভ্রমণের গল্প বলতে এসেছি। আবার হয়ত কেউ একজন- সে হোক নারী, হোক পুরুষ, কোন একদিন আমার মতই একা বেরিয়ে গিয়ে যতখানি পারে নিজের মত করে পৃথিবী দেখার সাহস করবে।
যাই হোক আবেদনের প্রায় পনের দিন পর ওরা ইমেইল করে জানালো আমাকে তারা ইন্টারভিউতে অংশ নেয়ার জন্য শর্টলিস্টেড করেছে। আমি খুব নার্ভাস বোধ করতে শুরু করলাম। আমি কিছুতেই এদের সাথে ভ্রমণের সুযোগ হারাতে চাই না। আমি কাজ করছি শরণার্থী নিজে, আমি জানতে চেষ্টা করছি নারীদের নিয়ে, তাই সব দিক দিয়ে এই সুযোগ আমার চাই-ই চাই। শুরু করে দিলাম এইসব বিষয়ে পড়াশোনা। এবং খুলে গেল এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত আমি পারব কি ওদের সাথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে? (চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানে নারী শিক্ষা কি আবারও বন্ধ হতে যাচ্ছে
পরবর্তী নিবন্ধআইআইইউসির ২৩৯তম সিন্ডিকেট সভা