শতবর্ষে ধূমকেতু

রেজাউল করিম | বুধবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব অনেকটা ধূমকেতুর মতো। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। ছোটো-বড় সবার জন্য তিনি লিখেছেন। কয়েক হাজার গানের স্‌্রষ্টা। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের বিভিন্ন সমস্যা, যন্ত্রণা নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল। সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও নৈরাজ্যের ছবি বিধৃত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে।
১৯২২ সালের ১১ আগস্ট (২৬ শ্রাবণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ) নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধূমকেতু নামের অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটি শুরুতে ফুলস্কেপ কাগজের চার পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়, পরবর্তীতে আট পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতো। প্রতি সংখ্যার দাম মাত্র এক আনা। চট্টগ্রামের হাফিজ মাসউদ আহমদের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত এ পত্রিকার সম্পাদক, সারথী ও স্বত্বাধিকারী স্বয়ং নজরুল। মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজাল উল হক, ম্যানেজার ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। ঠিকানা ৩ নং কলেজ স্কয়ার, কলকাতা। সপ্তম সংখ্যার পর অফিস চলে যায় ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেনে। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের মার্চে। ধূমকেতুর শতবর্ষ চলছে। এই পত্রিকায় নজরুলের ‘ধূমকেতু’ কবিতা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানান কবিগুরু। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ ধূমকেতুর কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে ‘মোহররম সংখ্যা’, ‘আগমনী সংখ্যা’, ‘দেওয়ালী সংখ্যা’ এবং ‘কংগ্রেস সংখ্যা’ উল্লেখযোগ্য। নজরুল জেলে থাকার সময় বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলাল এটি কিছুদিন সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার ঐ সংখ্যা নিষিদ্ধ করা হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তাঁর যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ঐ দিন তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তাঁর এই জবানবন্দি বাংলাসাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাঁকে আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাদণ্ডের প্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি ধূমকেতু’র ‘নজরুল সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এরপর কিছুদিন পত্রিকাটি বন্ধ থাকে। বীরেন ও কাঞ্জিলালের সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে বের হতে থাকে। ১৯২৩ সালের মার্চে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
ধূমকেতুতে নজরুল মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছিলেন। “স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।
পূর্ণস্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল-কিছু নিয়ম-কানুন-বাঁধন-শৃঙ্খল-মানা-নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে-সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, ‘আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ’! বলতে হবে, ‘যে যায় যাক সে আমার হয়নি লয়’!” নজরুল তাঁর ধূমকেতু কবিতায়ও যুগে যুগে ফিরে আসার বার্তা দিয়েছেন। ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু/ এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!’ মাত্র দুই দশকের সামান্য বেশি সবাক ছিলেন কবি। কেটেছে জীবন দুঃখ-কষ্টে। ধূমকেতুর শতবর্ষে কবির প্রতি রইল শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপূর্ণ ইচ্ছা
পরবর্তী নিবন্ধওসমান গনি