অপূর্ণ ইচ্ছা

রাদিয়া আফরীন নাশরাহ্‌ | বুধবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

(৩২,২১২)
এটি হলো একটি ছোট্ট নাতনির জীবনের ঘটনা। সে তার মা বাবা ও বৃদ্ধ দাদুর সাথে থাকে। সে এখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। সে সব সময় লক্ষ্য করে তার দাদুর সাথে মা বাবার খারাপ ব্যবহার। অকারণে মা দাদুর উপর গরম হয়ে যায়। বাবা অকারণে দাদুকে বকাবকি করে। দাদুর তাদের উপর কথা বলার কোন জোর নেই। কারণ তার থাকার কোন জায়গা নেই। খাওয়ানোর কোন মানুষ নেই। এমনকি তাঁর কিছু প্রয়োজন হলেও দাদু ভয়ে মা বাবাকে বলে না। বলার সাহসও করে না যদি তারা কথা শোনায়!
দাদুর জামায় কতবার খাবারের ঝোল পড়েছে। এখনো তার হলুদ দাগ আছে। তবু বলার সাহস নেই আমায় একটা নতুন জামা কিনে দাও। এটি অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এমনকি কোন উৎসবেও বাবা মা তাদের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনে, আমাকেও কিনে দেয় কিন্তু দাদুর জন্য কিনতে তাদের মনে থাকে না। যদি কখনো আমি বলার পর কেনে এবং বাড়িতে এসে আমি তা দাদুকে দিই তিনি কত খুশি হন। দাদুর মুখের হাসি আমাকে স্বর্গের সুখ এনে দেয়।
বাবা মা কখনো বকা দিলে দাদু আমায় সান্ত্বনা দেয়। দাদুর আদর, স্নেহ, হাসি সবকিছু আমার কাছে স্বর্গসুেেখর মত। মা বাবার এই ব্যবহারে আমি দাদুর পক্ষ হয়ে কিছু বলতে পারি না।
হঠাৎ একদিন মা বাবা ঠিক করলো দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে। তাহলে ঝামেলা বিদায় হবে। তারা ঠিক করলো পরদিনই আমার দাদুকে দিয়ে আসবে। তাই দাদুকে জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলতে বললো। দাদু আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না। তাকে তাঁর পরিবারকে ছেড়ে চলে যেতে হব? তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট্ট নাতনিটাকে ছেড়ে যেতে হব! দাদু মা বাবার কাছে অনুরোধ করলো তাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে না আসার জন্য। তাদের পায়ে পর্যন্ত পড়লো। এমনকি বললো আমি শুধু জল খেয়ে ঘরের এককোনায় পড়ে থাকবো, তাও বৃদ্ধাশ্রমে নয়। তাও তারা রাজি হলো না।
আমি যখন বুঝতে পারলাম তারা দাদুকে দূরে রেখে আসবে বলে ভাবছে আমিও তাদের অনেক বললাম। কিন্তু না।মনে হয় না তারা আমার কথা শুনবে। তাই আজ রাতই দাদুর সাথে কাটানো আমার শেষ রাত। আমিও আমার কান্না থামাতে পারলাম না। যে আমার জীবনের সবকিছু। আমার সবকিছুর উৎসাহ। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমার প্রিয় বন্ধু, তাকে আমার থেকে আলাদা করে দেওয়া হবে।
দাদুর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদু আমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। দাদুনাতির কান্নায় তাদের মন গললো না। দাদু সারারাত কেঁদেছে।
আমি দাদুকে সেই রাতে বলেছিলাম, দাদু, বড় হয়ে যখন আমি চাকরি করব আমি সেদিন আবার তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। তোমাকে নতুন জামা কিনে দেব। সবকিছু দেব। শুধু তুমি আর আমি থাকবো। তখন আর কেউ তোমাকে কোথাও দিয়ে আসবে না।
দাদু বললো, ঠিক আছে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো। কিন্তু দাদু জানে সেটা কখনও সম্ভব না। কারণ আমাদের বয়সের পার্থক্য যে অনেক। নাতনি কোন চাকরি করার অনেক আগেই যে সে এ পৃথিবী ত্যাগ করবে তাও বললো। ভালো করে লেখাপড়া করবে যাতে তুমি অনেক বড় চাকরি করতে পারো।
আমি সে রাতে দাদুর সাথে শেষ থেকেছিলাম। দাদু আমাকে কীভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল! জানি না আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম থেকে ওঠে সারা বাড়ি খুঁজেও দাদুকে কোথাও পেলাম না। কেঁদে বিছানা ভরে গেল তাও দাদুকে আর নিজের কাছে পাবো না। অনেক চেষ্টা করেছি তাও পারলাম না। মা বাবার উপর যাওয়ার সাহস যে নেই! তাই দাদুকে ফিরিয়ে আনার জন্য মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম।
এভাবেই তিনবছর কেটে যায়। একদিন বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাসায় ফোন আসে যে দাদু আর বেঁচে নেই।তা শোনার পর আমি কান্না থামিয়ে রাখতে পারলাম না।যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি এত চেষ্টা করছি। প্রত্যেকবার চোখের জল মুছে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম যে একদিন দাদুকে ফিরিয়ে আনতে পারবো। না জানি এত বছর দাদু আমাদের জন্য কতটা কেঁদেছে। ঠিক করে খেতে পেরেছে কিনা।তারা কেমন ব্যবহার করেছে।
দাদুকে আর কোনদিন দেখতে পাবো না। আমার জীবনের সেরা বন্ধু, আমার খেলার সাথি,আমার দাদু।আর কখনোই তাকে ফিরে পাবো না
আমার দাদুকে ফিরিয়ে আনা আর তাঁর সাথে থাকার ইচ্ছে টা অপূর্ণই রয়ে গেল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএগিয়ে যাবো
পরবর্তী নিবন্ধশতবর্ষে ধূমকেতু