লাওস নাকি মালয়েশিয়া

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

মালয়েশিয়ার ভিসা নিয়েছিলাম অনেকদিন আগে। ভিসার মেয়াদ শেষ হতে বেশিদিন নেই, কিন্তু ভিসা নিয়েও যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। অথচ থাইল্যান্ড থেকে অল্প সময়ের পথ। সমস্যা একটাই, বাংলাদেশি পাসপোর্টে ল্যান্ড বর্ডারে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া যাওয়া যায় না। শুধু মালয়েশিয়া কেন, আশেপাশের কোন দেশেই বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা স্থলপথে ভ্রমণ করতে পারে না। বলছি সেই ২০১৭ এর জুলাই এর কথা। এই দিকে আবার মালয়েশিয়াতে তখন বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশীদের ভিসা দিচ্ছিল না। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে সেটা নিয়ে খুব আলোচনা। এমনকী সেমিনার বা ট্রেনিং-এর জন্যেও ঝামেলা করছিল। যারা যেতে পারছিল তাদের নাকি মালয়েশিয়া ঢোকার সময় হেনস্তা করছিল। কারণ মালয়েশিয়ায় বসবাসরত এক পুরুষ নাকি, মালেশিয়ান এক নারীকে ধর্ষণ করেছে। সেই নারী আবার মালে জাতির। মালেশিয়াতে অনেক জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বাস করলেও, তিনটি জাতি সংখ্যায় বেশি- ভারতীয় বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান, চাইনিজ বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান এবং মালয়ে। মালয়ে জাতির মানুষেরা সেখানের পুরাতন বাসিন্দা। আর সেই জাতির কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে! বাংলাদেশ থেকে আমার বাড়ির মানুষ ফোন করে অনুরোধ করল সম্ভব হলে না যেতে। আমিও বুঝতে পারছিলাম না একা যাওয়া ঠিক হবে কী না। স্পাইসি রোডের সদস্যদের মালয়েশিয়া যাওয়ার কেনো প্ল্যান নেই। ওরা এখান থেকে যাবে লাওস নামের দেশে। আমার মালয়েশিয়ার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। আমি আগে লাওস যাবো নাকি মালয়েশিয়া যাবো ঠিক করতে পারছিলাম না। এইদিকে আমি যখন থাইল্যান্ডের পর্বতে ঘুরতে গিয়েছি, নিনা আর এলিনা সেদিন গিয়েছে চ্যাংরাই ঘুরতে। আমি আগে গিয়েছি বলে ওদের সাথে আর যাইনি। ওদের বেশ মজা হয়েছে ঘুরতে গিয়ে। চ্যাংরাইয়ের সাদা মন্দির দেখে ফেরার সময় ওরা যখন হিচহাইকিঙয়ের জন্য রাস্তায় ড্রাইভারদের অনুরোধ করছিল, ওদের লিফট দিল এক ডাচ ভদ্রলোক। তার সাথে ছিল নাকি তার বিশাল আলসেশিয়ান কুকুর। থাইল্যান্ডের আবহাওয়া বেশ গরম। কিন্তু, এলসেশিয়ান হল বরফের দেশের কুকুর। কুকুরের জন্য ভদ্রলোক তাই ঘরে এসি লাগিয়েছে। ডাচ ভদ্রলোক থাইল্যান্ডে প্রথম এসেছিল অনেক বছর আগে একটা এনজিও’র কাজে। তারপর এই দেশের প্রেমে পড়ে গিয়ে থেকেই গেল। গল্পে গল্পে যখন তিনি জানলেন যে নিনা আর এলিনা চ্যাংরাইয়ের কাছের বর্ডার দিয়ে লাওস যাবে, তিনি যেদিন ওরা লাওস যাবে সেদিন বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে। চ্যাংমাই শহর থেকে বর্ডার যেতে গাড়িতে প্রায় ৬/৭ ঘণ্টা লাগে। এতটা পথ কেবল ওদের দিয়ে পৌঁছে দিতে যাবে, এটা একটা পাগলামো ছাড়া আর কিছু না। আবার ফিরে আসতে হবে একা গাড়ি চালিয়ে। এই শুনে নাকি ভদ্রলোক তার পোষা কুকুরকে দেখিয়ে বলেছিল, ওর আসল বন্ধু থাকবে ওর সাথে। তাই একা লাগার কোনো কারণই নাই।
রাতে বসে আমরা আমার একা প্রথম হিচহাইকিঙয়ের গল্প বলছিলাম নিনা আর এলিনাকে। ওরাও ওদের গল্প বলছিল। মালয়েশিয়ার পরিস্থিতির কথা ওদের জানিয়ে, ওদের পরামর্শ চাইলাম। দু’জনেরই অনেক মন খারাপ হল পরিস্থিতির কথা জেনে। বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্যে অন্যান্য দেশের ভিসা পেতে এমনিতেই অনেক সমস্যা হয়, তার উপর যদি সেই পাসপোর্টধারীরা ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে যায়, তাহলে তো সেই দেশের মানুষের সম্পর্কে ভালো ধারণা হবার কোন কারণ নেই। অবৈধভাবে কাজের সন্ধানে বাংলাদেশীরা বিদেশ যায় বলে ভিসার সমস্যা বেশি হয়, আবার আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোন একটা বিষয় হয়তো আছে, যার ফলে বেশিরভাগ দেশে যেতে আমাদের ভিসা লাগে এবং সেটাও খুব সহজে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা এমন, কোন দেশে যাওয়ার আগে যেন নাকে খত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, ওই দেশে গিয়ে আবার ফিরে আসব এবং উলটাপাল্টা কিছু করব না।
নিনা আর এলিনার সাথে গল্পের এক ফাঁকে ওরা বলছিল ওদের প্রায় দেড় বছরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা। এই সময়ে স্পাইসি রোডের সদস্যেরা প্রায় ২৭ হাজার মাইলের উপর পথ ভ্রমণ করেছে ভ্রমণ নারী হিসেবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছিল রাশিয়াতে। সেখানে রাস্তায় লিফট চাইলে বেশিরভাগ ড্রাইভার সেক্স করার ইঙ্গিত দিতো। যদিও ওদের সাথে তখন পুরুষ সদস্য ইয়ান্নিকও ছিল। কিন্তু, তাতে নাকি রাশিয়ানদের অভদ্র ব্যাবহার বন্ধ হত না। আবার রাশিয়ায় ঢোকার সময় কিছুটা বর্ডারে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল নিনাকে। কারণ সে আস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও, থাকতো জার্মানিতে। আর অস্ট্রেলিয়া হল ইউনাইটেড কিংডমের অন্তর্ভুক্ত মানে, ব্রিটেনের রানীকে তারা রানী মানে। আবার ইরানের বর্ডারেও ওদের বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল।
তবে, প্রায় ৫০০ অপরিচিত ড্রাইভারের গাড়িতে দিন বা রাতে চড়ে, ৯৮ জন অপরিচিত মানুষের বাসায় কাউচসার্ফিঙয়ের মাধ্যমে থেকেও ওদের খুব কোনো যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়নি, কেবল ইন্ডিয়া ছাড়া। এলিনা বলছিল, ইন্ডিয়াতে রাস্তায় একটা ছেলে নাকি ওর বুকে রাত দিয়েছিল। এলিনা ভাবতে পারে না কেউ কার অনুমতি না নিয়ে গায়ে হাত দিতে পারে। ও নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, ছেলেটা ইচ্ছে করে বুকে হাত দেয়নি, হয়তো এক্সিডেন্টাল ঘটনা। আমার খুব মায়া লাগলো এলিয়ার জন্য। ওরা জানে না যে বাংলাদেশে এমন কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে না যে জীবনে একবারও যৌন হয়রানির শিকার হয়নি। রাস্তা ঘাটে, পরিবারে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, পাবলিক বাস-টেম্পুতে মেয়েরা প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হয়। আর নিনা বা এলিনার মত ১৮/১৯ বছরের মেয়েদের তো এই বীভৎসতার মুেখামুখি হতে হয় পদে পদে। এদেশে ধর্ষণ নিয়ে কথা বলা শুরু হয়েছে এই সেদিন হল। আমার জীবনে আমি অগনিতবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি যে, নিজের ভেতরে কেমন যেন একটা সেন্সর সেট হয়ে গেছে। কেউ গা ঘেঁষে গেলে শরীর সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যায়। এলিনার মতো দ্বিধা হয় না কেউ বিকৃত ইচ্ছে নিয়ে শরীর ঘেঁষে গেছে নাকি দুর্ঘটনাবশত গেছে সেটা নিরূপণ করতে। এই সেন্সর মনে হয় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়েরই একটা সময় পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। তো, সেই দেশের পুরুষেরা অন্য দেশে গিয়ে রাতারাতি তো আর মহাপুরুষ হয়ে যেতে পারে না! তাদের ভেতরের যে লোলুপতা সেটা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসে। বলে রাখা ভালো, ঢালাওভাবে সব পুরুষকে হয়তো দায়ী করা যায় না, কিন্তু এ অনেকটা ঠগ বাছতে গাঁও উজাড় হয়ে যাবার মত ব্যাপার। আর ব্যতিক্রম তো কখনও উদাহরণ হতে পারে না সার্বজনীন বিষয়ে।
নিনা জানালো ওর বাবা সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগে কাজ করে, তাই মালয়েশিয়াতে গিয়ে কোন সুবিধায় পড়লে ওকে জানাতে, ও সাহায্য করার চেষ্টা করবে। এখন ঠিক করতে হবে আগে আমি লাওস যাবো নাকি মালয়েশিয়াতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ
পরবর্তী নিবন্ধনারীর প্রতি নরেন্দ্র মোদির সম্মান ও একজন বিলকিস বানো