নারীর প্রতি নরেন্দ্র মোদির সম্মান ও একজন বিলকিস বানো

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

গত ১৫ই আগস্ট ছিল আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের স্বাধীনতা দিবস। এই দিবস উপলক্ষে সেই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন, অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে নারীর বিষয়টি উল্লেখ করছি, মহিলাদের অসম্মান বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নেওয়ার জন্য বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে কথাবার্তা এবং আচরণে আমরা এমন কিছু যেন না করি যা নারীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। তিনি আরও বলেন, ভারত হচ্ছে গণতন্ত্রের জননী।’ একসময় ভারতের এমন একটা পরিচয় ছিল। গান্ধীজী এমন একটা ভারতের জন্য জীবন দিয়েছেন যে ভারতের প্রতিটি নাগরিক তার গণতান্ত্রিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
শুধু ভারতবাসী নয় আমরা সহ সারা বিশ্ববাসী শুনলো ফ্লয়েডের সেই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি বিলকিস বানোর কন্ঠে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! আমাকে নিরাপদে বাঁচতে দাও। আমি বাঁচতে চাই। জানি না সে বাঁচার সুযোগ আদৌও পাবে কিনা। ২০০২ সালে গুজরাটের সামপ্রদায়িক ম্যাসাকারের সময় বিলকিস বানোর পরিবারের সাত সদস্যকে খুন করা হয়। পাশাপাশি অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়। তখন তার বয়স ছিল একুশ।এই ঘটনায় ১১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মুম্বাইয়ের এক বিশেষ আদালতে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিলো। স্বাধীনতার ৭৫ তম দিবস উপলক্ষে এই বীর বাহাদুরদের গুজরাট সরকার তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়েছে। শুধু তাই নয় তাদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে, মিষ্টি মুখও করানো হয়েছে। মোদির নারীর প্রতি সম্মান জানানোর নমুনাটা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করলো! বিলকিস ভয়ার্ত হরিণের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। আজ এখানে তো কাল ওখানে নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে। যে ঝড় তাকে গুড়িয়ে দিয়ে শেষ করে দিয়েছিল সেই ট্রমাট্রাইজ থেকে বের হয়ে আসতে না আসতে আবারও সেই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখির আশঙ্কায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
সামাজিক অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা হিংস্রতা, জাতিগত বিদ্বেষ, সামপ্রদায়িকতা বা যে-কোন যুদ্ধ বিগ্রহে ধর্ষণ একটি বহুল প্রচলিত অস্ত্র। প্রতিপক্ষের এই অস্ত্রকে কেউ আর অপরাধ হিসেবে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক বলে মানতে শুরু করেছে! এই অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে মোদি সরকার এটাই প্রমাণ করলো ভারত তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সচেতন নাগরিক এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এটাই আশার কথা। বিলকিস বানো ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। তিনিও একজন নারী। প্রান্তিক জীবন থেকে লড়াই করতে করতে এখানে উঠে এসেছেন। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে তিনি এই অসহায় নারীর পাশে দাঁড়াবেন। এই ধরনের জঘন্য অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া অমানবিক এবং বিপজ্জনক নজির।
সংখ্যালঘুরা সারা পৃথিবী জুড়ে নিগৃহীত হচ্ছে। কখনো ধর্মের নামে, কখনো বণের্র নামে। মানুষের হিংস্রতায় বিপন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক!
কিছুদিন আগে ভারতের একটা হাসপাতালে আসামের একজন নারীর সাথে আমার পরিচয় হয়। তার উচ্চারণে আমাদের দেশি টান থাকায় ঘনিষ্ঠতা বাড়লো কথাবার্তায়। জানা গেল তার বাড়ি বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। ৯০-এর দশকে তারা প্রভাবশালীদের ক্রমাগত চাপের মুখে তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেবাড়ি ফেলে আসামে চলে আসে। তাদের পাকা দোতলা দালান ছিল। মস্ত উঠোন ছিল। নানারকমের ফুল ও ফলের বাগান ছিল। তুলসীগাছ ছিল। সান বাঁধানো বড় পুকুরঘাট ছিল। এখন সব স্বপ্নের মতো। তাদের এখন তেমন কিছু নেই। আসামে স্বামীর একটা দোকান আছে। মোটামুটি চলে যাচ্ছে। এখানে হাসপাতালে এসেছে শ্বশুরকে নিয়ে। তার দুটো কিডনিই কাজ করছে না। তাই কিছুদিন পর পর ডায়োলেসিস করতে হয়। উনি বুঝতে পেরেছেন সময় ফুরিয়ে এসেছে। তাই গত ফেব্রুয়ারিতে ছেলে এবং ছেলের বউয়ের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করে তার শেষ ইচ্ছেটা জানিয়েছিলেন। একবার শুধু দেখে যেতে চান তার চৌদ্দ পুরুষের স্মৃতিময় বাড়িটা। যেখানে তার জীবনের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের বিশাল একটা অংশ রেখে এসেছেন। সেই স্মৃতি সেই মাতৃভূমি জীবনের শেষ সময়ে এসে তাঁকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। তার অন্তিম ইচ্ছে তার সেই বাড়িতে একটা দিন থাকার। ছেলে, ছেলের বউ কথা রেখেছিল। নিয়েও এসেছিল। কিন্তু বৃদ্ধের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এটা এখন মুসলমানের বাড়ি! দিনরাত নামাজ কালাম হয়। একজন হিন্দু পরপুরুষকে কীভাবে থাকতে দিতে পারে? গৃহকর্ত্রী আরও জানালো তার স্বামী এখন বিদেশে। তার ছোট ছোট সন্তান নিয়ে থাকে। এমন অবাস্তব প্রস্তাবে খুব বিরক্ত হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ বসে থেকে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে স্মৃতির ঝুড়িটা নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দুই একদিন থেকে আসামে ফিরে এসেছে। হঠাৎ মহিলার বুকে জমানো কষ্টগুলো চোখের জলের ধারায় নেমে আসে। আমি অসহায়ের মতো সিক্ত হচ্ছিলাম সেই কান্নায়, সেই যন্ত্রণায়! কতক্ষণ শব্দহীন বসেছিলাম মনে নেই। চারপাশ জুড়ে শুধু মানুষের পতনের শব্দ পাচ্ছি! সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি তুলসী গাছের কাহিনি গল্পটার কথা মনে আসছিল বারবার। মনে আসছিল বর্ণবাদী আমেরিকার পুলিশের সহিংসতায় নিহত ফ্লয়েডের কথা! মনে আসছিল অসংখ্য নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর কথা!
মানুষ মানুষের জন্য এমন ভয়ংকর হয়ে উঠছে কেন? মানুষ কেন মানুষের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারছে না? কৃষ্ণাঙ ফ্লয়েড মৃত্যুর আগে বলেছিল আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দাও। আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দাও! কিন্তু তারা নিঃশ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। এখন সারা বিশ্বজুড়ে সংখ্যালঘু মানুষের একটাই আর্তি আমাদের বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে দাও। আমাদের মতো করে আমাদের বাঁচতে দাও। বর্নের নামে ধর্মের নামে এই সহিংসতার শেষ কোথায়?

পূর্ববর্তী নিবন্ধলাওস নাকি মালয়েশিয়া
পরবর্তী নিবন্ধনজরুলের মানবতার সুর ও স্বর শিল্পীদের ধারণ করতে হবে