জাপানের বদলে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের পণ্য সরবরাহ করে টাকা আত্মসাৎ

প্রগতি ইন্ডাষ্ট্রিজের চট্টগ্রামের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুজ্জামানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

পণ্যের উৎস দেশ জাপান হতে হবে উল্লেখ করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রগতি ইন্ডাস্টিজ লিমিটেড। সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে টেন্ডার প্রাপ্ত হয়ে ট্রেডিং টেলেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানও টেন্ডার ডকুমেন্টসে পণ্যের উৎস দেশ জাপান হবে উল্লেখ করে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে ক্রয়াদেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু দেখা গেল টেন্ডারের শর্ত ভঙ্গ করে জাপান থেকে নয়, অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩০ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহ ও গ্রহণ করা হয় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে। এছাড়া ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭২০ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহকারীর নিকট থেকে গ্রহণ না করে মিথ্যা ও ভূয়া রিসিভ দেখিয়ে ও গুণগতমানের প্রত্যয়ন দিয়ে বিল ভাউচার সৃজন করে উক্ত টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ঘটনায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চট্টগ্রামের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুজ্জামানসহ (বর্তমানে জেনারেল ম্যানেজার, বিএসইসি) সংশ্লিষ্ট ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক।

গতকাল দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম১ এর উপসহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, ঢাকার কলাবাগানের ট্রেডিং টেলেন্টের মালিক মো. রাহাত হাসান, প্রগতির সাবেক উৎপাদন বিভাগীয় প্রধান কায়কোবাদ আলমামুন, সাবেক বিপণন বিভাগীয় প্রধান মো. সাইদুর রহমান জামালী, সাবেক হিসাব বিভাগীয় প্রধান মো. রেজাউল করিম, ক্রয় বিভাগীয় প্রধান মো. ছিদ্দিকুর রহমান দেওয়ান, সাবেক উপমহাব্যস্থাপক (প্রশাসন) মো. হুমায়ুন কবির, প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) বিশ্বজিত চৌধুরী ও সাবেক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. হায়াত মাহমুদ। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম১ এর উপপরিচালক নাজুচ্ছায়াদাত আজাদীকে বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রতারণা, অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার মাধ্যমে জাপান ব্যতীত ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩ টাকা মূল্যের পণ্য মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে সরবরাহ ও গ্রহণ করে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের সুনাম ক্ষুণ্ন ও ক্ষতি করেছেন এবং ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭২০ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে গ্রহণ না করে মিথ্যা ও ভূয়া রিসিভ দেখিয়ে ও গুণগতমানের প্রত্যয়ন দিয়ে বিল ভাউচার সৃজন করে উক্ত টাকা আত্মসাত করে দণ্ড বিধির ৪০৯, ১০৯, ৪২০ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫() ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

মামলার এজহারে বলা হয়, আসামি মো. তৌহিদুজ্জামান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের আগ্রাবাদ অফিসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালনকালে কারখানার উৎপাদন বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ১৩ প্রকার অঙিলারি মালামাল ক্রয়ে প্রাক্কলন দর নির্ধারণ করা হয় ৯৬ লাখ ৫৮ হাজার ৭০০ টাকা। চাহিত মালামালের স্পেসিফিকেশন ও কান্ট্রি অব অরিজিন জাপান উল্লেখ করে টেন্ডার সিডিউল/সিডিউল অব রিকুয়ারমেন্ট তৈরি করে টেন্ডার আহ্বান করে একই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ওটিএম পদ্ধতি অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তৌহিদুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণের পর ওটিএম পদ্ধতিতে ৩৬,০৯৩,০০৭,০৯,৭৭,০১৯,২০১৮,৬৪৪ নং টেন্ডার আহ্বান করলে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠান তিনটি যথাক্রমে ট্রেডিং টেলেন্ট, আহসান এন্টারপ্রাইজ ও সাবিদ কর্পোরেশন। সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলেন ট্রেডিং টেলেন্ট, যার বিড মূল্য ছিল ৯৬ লাখ ৬৪ হাজার ৬১০ টাকা এবং ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল আহসান এন্টারপ্রাইজ, যার বিড মূল্য ছিল ১ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৮৪০ টাকা।

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৩ টি অঙিলারি মালামালের মধ্যে ১২টির সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলেন মেসার্স ট্রেডিং টেলেন্ট যার বিড মূল্য ছিল ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯১০ টাকা। পিপিআর এর নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা তথা ট্রেডিং টেলেন্টকে ১২ প্রকার মালামাল সরবরাহের ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছিল যার ক্রয়াদেশ নং৫৫৫। ট্রেডিং টেলেন্ট ১২ প্রকার অঙিলারি মালামাল জাপান থেকে সরবরাহ করবে মর্মে প্রাইস সিডিউল ফর গুডস (ফরম পিজি৩৪৪) এ উল্লেখ করে। মালামালের উৎস দেশ জাপান অনুযায়ী প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং টেলেন্টকে ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯১০ টাকা মূল্যের মালামাল সরবরাহের ক্রয়াদেশ প্রদান করে।

এজাহারে আরো বলা হয়, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অফিসে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট একটি সভা হয়। এতে আসামিরা সুপারিশ করেন ক্রয়াদেশাধীন ৫ প্রকার মালামাল ট্রেডিং টেলেন্ট মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে সরবরাহ করেছেন। ৭ প্রকার মালামাল মালয়েশিয়া অথবা সিঙ্গাপুর অথবা জাপান থেকে সরবরাহ করবেন এবং গুণগতমান সঠিক থাকলে ক্রয়াদেশাধীন মালামাল গ্রহণ করবেন। সেখানে পণ্যের উৎস দেশের প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেন। এখানে উল্লেখ্য, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড চাহিত পণ্যের উৎস দেশ জাপান উল্লেখ করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করে এবং ট্রেডিং টেলেন্ট তার দাখিলকৃত টেন্ডার ডকুমন্টসে পণ্যের উৎস দেশ জাপান হবে উল্লেখ করে এবং তাদের সে অনুযায়ী ক্রয়াদেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু আসামিরা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজসে টেন্ডার সিডিউল, ফরম (পিজি ৩এ) অনুযায়ী ক্রয়াদেশ দেওয়া হলেও ১২ প্রকার মালামাল উৎস দেশ জাপান ব্যতীত অন্যান্য দেশের মালামাল গ্রহণ করবেন মর্মে সুপারিশ প্রদান করেন। এজাহারে বলা হয়, ট্রেডিং টেলেন্ট এঙ্মি ব্যাংক পান্থপথ শাখায় ১৪ হাজার ৪৬০ ডলার বা ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩১ টাকার তিনটি এলসি খোলার মাধ্যমে ক্রয়াদেশাধীন ৯ প্রকার মালামাল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে সরবরাহ করে। রেকর্ডপত্র অনুযায়ী শুধু ০০০০১৯৪৭১৯০১০০৭৭ নং এলসির মাধ্যমে জাপান থেকে ১০ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকার পণ্য সরবরাহ করা হয়। ট্রেডিং টেলেন্ট তিনটি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে শুল্কায়ন করে জাপান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে ৬৫ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ টাকা মূল্যের ক্রয়াদেশাধীন ১২ প্রকার অঙিলারি মালামালের মধ্যে ৯ প্রকার মালামাল আমদানি করেছে। ক্রয়াদেশ অনুযায়ী ১২ প্রকার অঙিলারি মালামাল জাপান থেকে সরবরাহ করার উল্লেখ থাকলেও ১০ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকার ১ প্রকার মালামাল জাপানের পণ্য সরবরাহ করে অন্যান্য আসামিদের সাথে যোগসাজশ করে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩০টাকা মূল্যের ৮ প্রকার মালামাল থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে সরবরাহ করেছে এবং অবশিষ্ট ২ প্রকার মালামাল ক্রয়/আমদানির কোনো রেকর্ডপত্র অনুসন্ধানকালে দাখিল করতে পারেনি। রেকর্ডপত্র অনুযায়ী ট্রেডিং টেলেন্ট থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে তিনটি এলসির মাধ্যমে মোট ৬৫ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ টাকার অঙিলারি পণ্য সরবরাহ করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনটি ভাউচারের মাধ্যমে ১১ প্রকার মালামাল গ্রহণের বিপরীতে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মোট ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ৭৫০ টাকার বিল পরিশোধ করেছে। বাকী ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭২০ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহ করেছে কি না সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ দাখিল করতে পারেনি।

প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ শুধু ৬৫ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করে। ৫৫৫ নং ক্রয়াদেশাধীন অঙিলারি মালামালের ১ ও ৭ নং আইটেম প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে পণ্য সরবরাহ দেখিয়ে ট্রেডিং টেলেন্ট তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে ডেলিভারি চালানে পণ্যের তালিকা উল্লেখ করে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ বরাবর বিলের জন্য দাখিল করলে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা কায়কোবাদ আলমামুন, হায়াত মাহমুদ ও বিশ্বজিত চৌধুরী মালামাল রিসিভ দেখিয়ে ও গুণগতমানের প্রত্যয়ন দিলে প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমের সহায়তায় মিথ্যা বিল ভাউচার সৃজন করে ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭২০ টাকা আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির হলে ছাত্রলীগ কর্মীর রুমে মদের খালি বোতল, সিলগালা
পরবর্তী নিবন্ধ৭২ ঘণ্টার নতুন হিট অ্যালার্ট জারি