রোমাঞ্চকর জয়ে সেমির আশা

শান্তর লড়াকু ব্যাটিং, তাসকিন-মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বল

ক্রীড়া প্রতিবেদক | সোমবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

ক্রিকেট কখনো কখনো বড় নিষ্ঠুর। ক্রিকেট কখনো কখনো গায়ে হিম ধরায়। হৃদ কম্পন বাড়ায়। কখনো হাসায় আবার কখনো হাসি কেড়ে নেয়। আর সে কারণেই ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার এক খেলা। তবে ক্রিকেটে কিছু কিছু জয় চরম নাটকীয়তায় ভরা। কিছু জয় রোমাঞ্চকর। ক্রিকেটে কত ঘটনাইতো ঘটে। ৬ বলের ওভার কখনো কখনো ১২ বলেও হয়। হ্যাটট্রিক হয়, ব্যাট ভাঙ্গে, স্টাম্প ভাঙ্গে আরো কত কিছু। কিন্তু গতকাল অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের গাব্বা স্টেডিয়ামে যা ঘটেছে তা কি ক্রিকেটে আর কোনো কালে ঘটেছে? শিহরণ জাগানো এক জয় নিয়ে বাংলাদেশ দল মাঠ ছেড়েছে। তীরে এসে তরি ডুবিয়ে হতাশার পরাজয় নিয়ে জিম্বাবুয়ে ফিরে গেছে মাঠের বাইরে। হয়তো ম্যাচ সেরার পুরস্কার প্রদানের প্রস্তুতিও চলছিল। কমেন্ট্রি কক্ষে আতহার আলি খানের গলা যখন আকাশ ছাড়িয়ে তার উপরে চলে যাওয়ার উপক্রম, ঠিক উল্টো দিকে পমি মাভাঙ্গার গলা যেন বসে আসছিল। গলায় কাটা বিধছিল জিম্বাবুয়ের পরাজয়। ঠিক তখনই ক্রিকেট জন্ম দিল নতুন আরেক ঘটনা। জিতেও জেতা হলো না বাংলাদেশের। আর হেরেও যেন হারেনি জিম্বাবুয়ে। তাহলে জিতল কে?

উত্তর একটাই ক্রিকেটর চরম নাটকীয়তা। কিংবা ক্রিকেটের গৌরমময় অনিশ্চিত চরিত্র। বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে যখন হার-জিত মেনে নিয়ে ফিরে গেছে মাঠের বাইরে। ডাগআউটের সামনে দুই দলের ক্রিকেটারদের করমর্দনও হয়ে গেল। কিন্তু দুই আম্পায়ার তখনও মাঠে ঠায় দাঁড়িয়ে। গোটা স্টেডিয়াম অবাক হয়ে দেখল ম্যাচ এখনও শেষ নয়। তখন স্টেডিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিণে ভেসে উঠল মোসাদ্দেক হোসেনের করা ইনিংসের শেষ বলটি ছিল নো বল। ক্রিকেটের নো বল হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এবার দেখা গেল আরো একটি কারণ। শেষ বলে নুরুল হাসান সোহান স্টাম্পিং করেন জিম্বাবুয়ে ব্যাটসম্যান মুজরাবানিকে। কিন্তু সোহান বলটি ধরতে গিয়ে তার গ্লাভস চলে আসে স্টাম্পের সামনে। ফলে সেটি নো বল। জয়ের আনন্দে মাঠ ছাড়া বাংলাদেশকে আবার ফিরতে হলো মাটে। জিম্বাবুয়ের জন্য আবার নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হলো। এক বলে করতে হবে ৪ রান। সঙ্গে ফ্রি হিট। কত কিছুইতো হতে পারে। তাহলে কি জয়টা আবার হাতছাড়া হয়ে যাবে? কিন্তু শেষ বল করতে আসা মোসাদ্দেক আত্নবিশ্বাস হারাননি। জোরের উপর করা মোসাদ্দেকের বলটি খেলতেই পারলেন না মাজরাবানি। জয়টা ঠিকই থাকল বাংলাদেশের। বরং ৪ রানের জয়টা হয়ে গেল ৩ রানের। জয়টা আবার পকেটে পুরল বাংলাদেশ। তবে সেটা উত্তেজনা, থ্রিলার, নাটকীয়তা, হৃদ কম্পন বাড়িয়ে দেওয়া, শিহরণ জাগানো আরো কত কি। আর এটাই যেন ক্রিকেটের সৌন্দর্য। এটাই ক্রিকেটের চিরাচরিত চরিত্র। ক্রিকেটের রং, রূপ, নির্যাশ সবকিছু যেন তিলে তিলে অনুভব করল এই ম্যাচে দর্শকরা। তবে দিন শেষে শেষ হাসিটা বাংলাদেশেরই। বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বে দ্বিতীয় জয় তুলে নিল সাকিবের দল। সে সাথে নিজেদের রাখল সেমিফাইনালের পথেও। যদিও সে পথ এখনো অনেক বন্ধুর।

এক সময় বলে কয়ে হারানো জিম্বাবুয়ে এখন আবার বাংলাদেশের কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। কিছু দিন আগে জিম্ববাুয়ের মাঠে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরে এসেছে বাংলাদেশ। তার উপর এই বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বের ম্যাচে পাকিস্তানের মত দলকে হারিয়ে নিজেদের জায়ান্ট কিলারে পরিণত করেছিল জিম্বাবুয়ে। তবে শেষ কিছুতে শেষ পর্যন্ত জল ঢেলে দিল বাংলাদেশ। বড় কঠিন সময়ে কঠিন ও নিষ্ঠুর এক জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। যে জয়টি বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল টাইগারদের জন্য। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ অবধি যেন নাটকীয়তায় ভরা। প্রতিটা মুহূর্তে আনন্দ যেমন দিয়েছে তেমনি উদ্বেগ, উৎকন্ঠার মধ্যে রেখেছিল দর্শকদের। পেন্ডুলামের ঘোড়ার মত যেন দুলছিল ম্যাচটি এদিক-ওদিক। শেষ জয় নামক সেই সোনার হরিন ঠিকানা খুজে নিল টাইগার তাবুতে। সমালোচনার তীরে পিট দেওয়ালে ঠেকে যাওয়া থেকে নাজমুল হোসেন শান্ত বেরিয়ে এলেন দারুণ এক হাফ সেঞ্চুরি দিয়ে। নিজের কাটারটাকে নেইল কাটারে পরিণত করা মোস্তাফিজ ফিরলেন চির চেনা রুপে। তাসকিনের গতি যেন বেড়ে গেল আরো বহুগুন। সবমিলিয়ে সুখের একটা দিল ছিল গতকাল। কিন্তু শেষটা হলো রূদ্ধশ্বাসে।

ম্যাচের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ওভারে সৌম্য সরকার বিদায় নেন রানের খাতা খোলার আগে। লিটন দাস শুরু করেছিলেন চার দিয়ে। কিন্তু ফিরলেন একেবারে অবিবেচকের মত অপ্রয়োজনীয় ও দৃষ্টিকটু স্কুপ শট খেলতে গিয়ে। ১২ বলে ১৪ রান করেন লিটন। অধিনায়ককে নিয়ে বেশ ভালই এগিয়ে যাচ্ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। গড়েন ৪৪ বলে ৫৪ রানের জুটি। সাকিবও ফিরলেন অপ্রয়োজনীয় এক শট খেলে। ২০ বলে ২৩ রান আসে অধিনায়কের ব্যাট থেকে। এরপর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন শান্ত। সফলও হয়েছেন তিনি। ১৫ ইনিংসের ক্যারিয়ারে তুলে নিলেন প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। ৪৫ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর আরো মারমুখি হওয়ার চেষ্টা করেন শান্ত। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরেছেন ৭১ রান করে। বাকি ২১ রান নিয়েছেন মাত্র ১০ বলে। আফিফের ১৯ বলে ২৯ রানের ক্যামিওতে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৫০। শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশ সংগ্রহ করে ৪৭ রান।

১৫১ রানের টার্গেট। তাসকিন প্রথম ওভারেই হানলেন আঘাত। ইনিংসের তৃতীয় বলেই ফেরালেন মাধবিরীকে। নিজের পরের ওভারে আবার আঘাত তাসকিনের। এবার উইকেটের পেছনে সোহানের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক এরভিন। ষষ্ট ওভারে অধিনায়ক বল তুলে দিলেন মোস্তাফিজের হাতে। দ্বিতীয় বলেই মিল্টন শোম্বাকে ফেরালেন মোস্তাফিজ উইকেটের পেছনে সোহানের ক্যাচে পরিণত করে। এরপর উইকেটে জিম্বাবুয়ের সবচাইতে বড় ত্রাতা সিকান্দার রাজা। কিন্তু রাজা এলেন আর গেলেন। তিন বল খেলে রানের খাতাও খুলতে পারেননি তিনি। আফিফের ক্যাচ বানিয়ে মোস্তাফিজ তুলে নিলেন প্রথম ওভারেই দুই উইকেট। ৩৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে জিম্বাবুয়ে যখন খাদের কিনরায় তখন হাল ধরার চেষ্টা করেন উইলিয়ামস ও চাকাভা। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে চাকাভাকে হারিয়ে নিজের তৃতীয় উইকেট তুলে নেন তাসকিন। ভাঙ্গে ৩৪ রানের জুটি। আর সে সাথে এবারের বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত ৮ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তাসকিন। ৬৯ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশ যখন জয়টা প্রায় নিজেদের পকেটে পুরে ফেলেছে মনে করছিল তখনই বুক চিতিয়ে লড়াই করতে থাকেন উইলিয়ামস। ষষ্ট উইকেটে রায়ান বার্লের সাথে ৬৩ রানের জুটি গড়ে খাদের কিনারা থেকে জিম্বাবুয়েকে নিয়ে আসেন উইলিয়ামস প্রতিদ্বন্দ্বীতার মঞ্চে। ১৯তম ওভারে সাকিব আল হাসানের অসাধারণ এক থ্রোতে উইলিয়ামস রান আউট হয়ে ফিরলে বাংলাদেশ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। বুক থেকে নেমে যায় একটি বিশাল পাথর।

কারণ ৪২ বলে ৬৪ রান করা উইলিয়মাস যে তার দলকে নিয়ে যাচ্ছিলেন জয়ের দিকে। এরপর এলো শেষ ওভারের নাটক। ৬ বলে দরকার ১৬ রান। মোসাদ্দেকের করা প্রথম বলতে থেকে লেগবাই হিসেবে এক রান নেন বার্ল। দ্বিতীয় বলে ছক্কা মারতে গিয়ে একেবারে সীমানার কাছে ধরা পড়েন ইভানস। চার বলে দরকার ১৫ রান। কিন্তু এনগারাবার পায়ে লেগে তৃতীয় বলটি হয়ে গেল চার। ব্যবধান কমল জিম্বাবুয়ের আর উত্তেজনা বাড়ল বাংলাদেশের। চতুর্থ বলে ছক্কা মেরে দিলেন এনগারাবা। শেষ দুই বলে তখন দরকার ৫ রান। এবার মোসাদ্দেকের বুদ্ধির কাছে হার মানলেন এনগারাবা। এগিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বল মিস করায় স্টাম্পিং হয়ে ফিরলেন এনগারাবা। এবার শেষ বলের নাটক। এবারো স্টাম্পড হলেন মুজরাবানি। কিন্তু সেখানেই ঘটে গেল বিপত্তি। শেষ হওয়ার পর সেই বলটি আবার খেলতে নামতে হলো বাংলাদেশকে। কিন্তু মোসাদ্দেকের বুদ্ধির কাছে এবার আবারো হার মানলেন মুজরাবানি। শুধু ৪ রানের জয়টা হয়ে গেল ৩ রানের। সেটাই যা পার্থক্য। বাকিটা ইতিহাস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদারুণ লড়াই, শেষ ওভারে আফ্রিকার জয়
পরবর্তী নিবন্ধজোট সরকারের নির্যাতন অনেকে ভুলে গেছে : শেখ হাসিনা