রহস্যেঘেরা খুনি হ্রদ

আরিফ রায়হান | বুধবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর আর তার প্রকৃতি নানা রহস্যে ভরপুর। আর এ রহস্যের সবটুকু জানাও সম্ভব নয়। তবে মানুষ রহস্যের খোঁজে থাকে সবসময়। এতে কিছু রহস্য উদঘাটন হয় আর কিছু রহস্য থাকে অনাবৃত। পৃথিবীর নানা দেশে এমন অনেক হ্রদ রয়েছে, যেগুলোকে ঘিরে নানা রহস্য প্রচলিত আছে। তেমনি সে রকম এক রহস্যময় হ্রদের কথা বলবো। যে হ্রদের অবস্থান দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায়। হ্রদটি যেন দৃশ্যমান যমপুরী। বাস্তবে মৃত্যু না থাকলেও মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর শাস্তি আছে। বিষয়টা ঠিক রূপকথার গল্পের মতো, তবে মারাত্মক ভয়ঙ্কর। তানজানিয়ার এই হ্রদটি এখনো রহস্যময়। হ্রদের ধারে দেখা যাবে সারি সারি পাথরের পশুপাখির অনেকগুলো মূর্তি। দেখলে মনে হবে এগুলো কোনো ভাস্করের হাতের নিখুঁত ভাস্কর্য। সযত্নে তৈরি করা হয়েছে বাদুড়, মাছরাঙা, রাজহাঁস, ঈগলের মতো অনেকগুলো প্রাণীর মূর্তি। যেন জীবন্ত জীবাশ্ম।
হ্রদটির নাম ‘নেট্রন’। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার উত্তর প্রান্তে হ্রদটির অবস্থান। লবণাক্ত হ্রদটির দৈর্ঘ্যে ৫৭ কিলোমিটার, প্রস্থে ২২ কিলোমিটার এবং জলের গভীরতা মাত্র ১০ ফুট। বছরের বেশিরভাগ সময় লেকের জলের তাপমাত্রা থাকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। হ্রদটিতে এওয়াসো নায়গ্রো নদীর জল এসে পড়ে। আশপাশের বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণের জলও পড়ে এই হ্রদে। ফলে এ হ্রদের পানি বিভিন্ন খনিজে সমৃদ্ধ। নানা সময় এই হ্রদ নিয়ে বহু গল্পকথা শোনা গেলেও বাস্তবে কখনো কোনো কিছুর দেখা মেলেনি। ২০১১ সালে নিক ব্রান্ডট নামে এক ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নেট্রন হ্রদের সামনে গিয়ে চমকে যান। হ্রদের তীরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাখি আর বাদুড়ের স্ট্যাচু দেখতে পান নিক। তার মনে হলো- কেউ যেন নিঁখুতভাবে এগুলো তৈরি করে ফেলে রেখেছে হ্রদের তীরে। একটি পাখির স্ট্যাচুকে হাতে তুলে নেন নিক। স্ট্যাচুটি বেশ ভারি মন হলো তার। এটিকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে তার মেরুদন্ড বরাবর যেন একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। নিক বুঝতে পারেন যেটিকে তিনি স্ট্যাচু ভাবছেন, সেটি মোটেও স্ট্যাচু নয়। জীবন্ত অবস্থায় পাথর হয়ে যাওয়া একটি পাখির মমি। বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর নিক আবার তীরের দিকে হাটঁতে শুরু করেন। এবার নিকের ক্যামেরায় ধরা পড়তে শুরু করে ভয়ানক কিছু ছবি। পাথর হয়ে যাওয়া মেছো ইগল, মাছরাঙা, চড়াই, রাজহাঁস আরও কত পাখি আর বাদুড়। হয়তো কোনভাবে তারা এই হ্রদের জল ছুঁয়েছিল। যে কারণে সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত পাথর হয়ে গিয়েছিল এসব প্রাণী। প্রাণীগুলোর দেহ এমন নিখুঁতভাবে জমে গিয়েছে, মনে হবে, কোন ভাস্কর পাথর খোদাই করে স্ট্যাচুগুলি বানিয়ে রেখেছেন।
জানা যায়, সোডিয়াম কার্বোনেট এবং সোডার পরিমাণ অত্যধিক বেশি এই হ্রদের জলে। প্রচুর সোডিয়াম ও কার্বোনেট যুক্ত ট্র্যাকাইট লাভা দিয়ে প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে প্লিসটোসিন যুগে তৈরি হয়েছে নেট্রন হ্রদের তলদেশ। পরীক্ষায় জানা যায়, হ্রদের জল অস্বাভাবিক ক্ষারধর্মী। যা ত্বককে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষার পশুপাখির পক্ষে কোনোভাবেই সহনীয় নয়।
কীভাবে এতগুলি প্রাণী জীবন্ত স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল, তা কেউ জানে না বা দেখেনি। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সূর্যের রশ্মি হ্রদের গাঢ় জল থেকে আয়নার মত প্রতিফলিত হয়েছিল। লেক থেকে ঠিকরে আসা সূর্যরশ্মি পড়েছিল লেকের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিদের চোখে। চোখ ধাঁধিয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে লেকের জলে আছড়ে পড়েছিল পাখি ও বাদুড়গুলি। লেকের জলে থাকা ঘন সোডা আর নুন প্রাণীগুলির শরীরে লেগেছিল। আর জলের অতিরিক্ত ক্ষারের কারণে সেগুলোর মৃত্যু হয়েছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগমন
পরবর্তী নিবন্ধশান্তনু বিশ্বাসের কবিতা সমগ্রের প্রকাশ অনুষ্ঠান