যেভাবে সমাপ্তি ঘটে এক অভিযাত্রীর স্বপ্নের

| মঙ্গলবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

অ্যাডভেঞ্চার! ওই নেশাই তাকে টেনে নিয়েছিল কক্সবাজারের টেকনাফে। ২০২০ সালের জুলাই মাসের শেষ দিন সন্ধ্যার পর বাহারছড়ার এক পাহাড়ে উঠে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন টাইম ল্যাপস ভিডিও। পরদিন ভোরের সূর্যের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ খানের আর দেখা হয়নি। খবর বিডিনিউজের। মেজর সিনহা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে বানাতে শুরু করলেন ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি। অবশ্য সেটা ছিল কেবল শুরু। তার স্বপ্ন ছিল বিশ্ব ভ্রমণের।
সেই রাতে পাহাড় থেকে নেমে নিজের রুপালী রঙের টয়োটা অ্যালিয়ন চালিয়ে ফেরার পথে শামলাপুর চেকপোস্টে থামানো হয় সিনহাকে। পুলিশের গুলিতে অপমৃত্যু ঘটে তার স্বপ্নের।
কক্সবাজারে ‘জাস্ট গো’ নামের ওই ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে সিনহার সঙ্গী ছিলেন ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের ছাত্রী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত আর তাহসিন রিফাত নূর। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে শিপ্রার সঙ্গে সিনহার পরিচয়, বন্ধুত্ব; সেখান থেকেই ‘জাস্ট গো’র শুরু।
শামলাপুরের ঘটনার দুই সপ্তাহ পর এক সাক্ষাৎকারে শিপ্রা বলেছিলেন, ‘সিনহা যে স্বপ্নটি দেখতে দেখতে মারা গেছে, যে স্বপ্নের জন্য মারা গেছে, আমি তো শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত সেই স্বপ্নটা মেরে ফেলতে দেব না। আমি সেই স্বপ্নটা বহন করতে চাই, শেষ পর্যন্ত।’ জীবনের দীর্ঘ পথে সেই স্বপ্ন শিপ্রা কতটা বয়ে নিতে পারবেন, তা বলে দেবে ভবিষ্যৎ। তবে তার একটি চাওয়া ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। ফিল্ম বানানোর নেশায় বিভোর এই তরুণী চেয়েছিলেন ‘জাস্টিস’। কঙবাজারের আদালত সিনহাকে হত্যা করার দায়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির রায় দিয়েছে।
সেই ছেলেবেলা থেকেই বেড়াতে পছন্দ করতেন সিনহা মো. রাশেদ খান, পরিবারে তার ডাকনাম ছিল আদনান। বড় হয়ে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সিনহার বাবা এরশাদ খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। বাড়ি যশোরে হলেও বাবার বদলির চাকরির সুবাদে জেলায় জেলায় ঘুরতে হয়েছে সিনহার পরিবারকে। তারা রাঙ্গামাটিতে থাকার সময় ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই সিনহার জন্ম। কঙবাজারের উখিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ঘুরে সিনহার পরিবার গেল সিরাজগঞ্জে।
হারানো ছেলের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তার মা নাসিমা আক্তার এক সাক্ষাৎকারে যেন দেখতে পাচ্ছিলেন কৈশোরের সেই আদনানকে। বলেছিলেন, ‘ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রচণ্ড নেশা ছিল। সে ছিল স্বাধীনচেতা। একবার/দুইবার রিডিং পড়ত, সেটাই ছিল ওর পড়া। এতে ওর বাবার কোনো আপত্তি ছিল না, আমারও ছিল না।’
তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘যখন ক্লাস টুতে পড়ে, তখন থেকেই আদনান বলত সে হিমালয়ে যাবে। এটা শেষ করে বিশ্ব ভ্রমণে অন্যান্য যায়গায় বের হওয়ার কথা ছিল তার। বিশ্ব ভ্রমণ মানে বিলাসবহুল হোটেলে থেকে বেড়ানো নয়, অলিতে-গলিতে ঘুরে তাঁবু খাটিয়ে থাকা। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সিনহা। বিশ্ব ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য ২৫ কেজির ব্যাকপ্যাকও রেডি করে রেখেছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল, ওর ভ্রমণে আর যাওয়া হয়নি।’
কঙবাজারে থাকার সময় ২৬ জুলাই ছিল সিনহার জন্মদিন। তার জন্মদিনে মোবাইলে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি মা ও বড় বোন অনলাইনে উপহারও পাঠিয়েছিলেন। মা নাসিমা আক্তার বলেন, ‘তার জন্ম যেই মাসে, মৃত্যুও সেই মাসে। তার জন্ম পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ঘেরা জায়গায়, সেই পাহাড়-সমুদ্র ঘেরা জায়গায় তার মৃত্যু হল।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবার দীর্ঘ যানজটের কবলে কালুরঘাট সেতু
পরবর্তী নিবন্ধসিনহা হত্যার ঘটনাক্রম