যেভাবে উন্নয়শীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ

| সোমবার , ২২ মার্চ, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় মুন্সীগঞ্জের আহসান উল্লাহ তখন ১৬ বছরের কিশোর। বাবা নেই। জায়গা-জমি কিংবা সম্পদও নেই। কৃষি কাজে দিনমজুরিই একমাত্র ভরসা। অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। পঞ্চাশ বছর পর আহসান উল্লাহ এখন স্বচ্ছল। ১৮ একর জমিতে করছেন আলু চাষ। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন কৃষি বীজের ব্যবসা। মুন্সীগঞ্জ ছাড়িয়ে এটি বিস্তৃত হয়েছে অন্যান্য জেলাতেও। গত পঞ্চাশ বছরে কৃষক আহসান উল্লাহর যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি কৃষি খাতেও নতুন নতুন জাতের ফলন শুরু হয়েছে। গতানুগতিক ধান, গম, আলু, ভুট্টা ছাড়াও ক্যাপসিকাম, ড্রাগন ফল কিংবা স্ট্রবেরির মতো নতুন কৃষি পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়েছে। এতে অনেক কৃষক লাভবান হয়েছেন। হয়েছে কর্মসংস্থান। উৎপাদন বাড়ায় দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়েও স্বাধীনতার পর ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি ছিল। খবর বিবিসি বাংলার।
অর্থনীতি বদলেছে যেভাবে : মোটা দাগে কয়েকটি সূচকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অর্থনীতির চিত্র বোঝা যায়। বিবিএস ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে সময় জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। পঞ্চাশ বছর পর রফতানি আয় বহু গুণ বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। অর্থাৎ ২,০৬৪ ডলার। দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে দেশটি এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে।
উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর : বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে ৩টি শর্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্ত পূরণ করে। পরে ২০২১ সালে ৩টি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ সেই সুপারিশ পেয়েছে। ৩টি শর্ত হচ্ছে মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। মাথাপিছু আয়ে জাতিসংঘের শর্ত পূরণে ন্যূনতম দরকার ১ হাজার ২শ ৩০ ডলার। বাংলাদেশে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থনৈতিক ঝুঁকি কতটা আছে, সেটা নিরূপণে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হয়। বাংলাদেশ ২৫.২ স্কোর করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় দরকার ৬৬-এর উপরে স্কোর। বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৩.২ স্কোর।
অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক দশকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে। রেমিটেন্স বেড়েছে। কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নও হয়েছে।
মূলত প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও উৎপাদন, রফতানি বৃদ্ধি, সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে। শুরুতে কৃষি খাত এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখলেও আশির দশক থেকে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাক খাত। রফতানি ও কর্মসংস্থান দুই ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতের বড় ভূমিকা আছে।
বাংলাদেশ রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ খাতে কাজ করে লাখ লাখ শ্রমিক, যাদের সিংহভাগই নারী। তাদেরও জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে।
মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতি : শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। জাতিসংঘের সূচকে এক্ষেত্রে দেশের স্কোর ৭৩.২ শতাংশ। এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। ২০১৮ সালে এসে তা প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে। এছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে ২শ ১২ জন। এটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯।
১৯৯১ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অপুষ্টি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সেখানে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ভূমিকা রেখেছে। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া এবং সেবা নিতে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সরকারের সঙ্গেও আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা নিয়ে যৌথভাবে কাজ করেছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নিরেট অর্থনৈতিক সক্ষমতাও এমনভাবে বেড়েছে, যেখানে বিদেশি ঋণ সহায়তা নির্ভর উন্নয়নে অভ্যস্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করছে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট পদ্মাসেতু। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের রূপান্তরের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলকডাউন বা সাধারণ ছুটির কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধমমতা শঙ্করে মুগ্ধ চট্টগ্রাম