মোবাইল আর্থিক সেবা শিল্পে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত জরুরি, আপস কাম্য নয়!

মহিউদ্দিন বাবর | শনিবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশন এ মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। এই শিল্পকে কোনভাবেই মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সাময়িক ব্যবসার চাবি বলা যাবে না। সম্প্রতি একটি গোলটেবিল আলোচনায় এই শিল্পে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণের পক্ষে মত দেন বিজ্ঞ আলোচকেরা।
প্রাসঙ্গিকভাবেই গত এক দশকে মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয়। এটা সহজেই অনুমেয় যে, আগামী বছরগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এই খাতে নতুন নতুন কোম্পানি আসছে, এবং এখনই উপযুক্ত সময় এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কমপ্লায়েন্সের আওতায় আনার জন্য।
মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যারা এতদিন ব্যাংকিং সেবার বাইরে ছিল তারা আধুনিক আর্থিক সেবা পাচ্ছেন। এটা এতোটাই ব্যবহারবান্ধব যে, একজন মানুষ, যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তিনিও খুব সহজে এই সেবা নিতে পারেন। মোবাইল ফোনের দাম হ্রাস ও সহজলভ্যতা সাধারন জনগণের মাঝে এই সেবা পৌঁছে দিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে ।
এখন দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রহন করছেন। প্রতিদিন এর মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মোবাইল এর মাধ্যমে লেনদেনের হিসেবে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পঞ্চম।
এই শিল্পে বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি জোড়েসোড়ে আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে এই সেবার মাধ্যমে সাম্প্রতিক কিছু প্রতারণামূলক লেনদেন নজড়ে আসার পর থেকে। এই পালে হাওয়া লাগিয়েছে ই-কমার্স সেক্টরের সাম্প্রতিক ঘটনাচক্র যা অনাকাঙ্খিত ছিল। কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় ই-কমার্স খাতের অগ্রযাত্রা আমাদের যতোটা আশাবাদী করে তুলছিল পরবর্তী ঘটনাগুলো তার চেয়েও বেশি মর্মাহত করেছে। তাই আমাদের মোবাইল আর্থিক সেবা নিয়ে সাবধান হওয়াটা জরুরী।কমপ্লায়েন্স এর সবসময়ই একটা আইনী দিক থাকে। এটি বিভিন্ন আইনী বাধ্যবাধকতার সাথে সম্পৃক্ত। এর পরিসর অনেক বড়। নৈতিক, সামাজিক, প্রযুক্তির মানদন্ড এমনকি পরিবেশ মানদন্ডও এর আওতায় পড়ে। এটা নিশ্চিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরী।
আবার, যেকোন শিল্পের জন্য আইনী, আর্থিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত মানগুলির সেট মেনে কাজ করা একটি পূর্বশর্ত যা সেক্টর থেকে সেক্টরে আলাদা হতে পারে। প্রযুক্তিগত, আর্থিক, প্রশাসনিক অস্বাভাবিকতা, সামাজিক সমপ্রীতি লঙ্ঘন, ভোক্তাদের প্রতারণা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব এড়াতে শিল্প বা যে কোনও ব্যবসাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নিয়ম ও ব্যবস্থার করা প্রনয়ন করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, উন্নত বিশ্বে কমপ্লায়েন্স সব সময়ই যেকোন ব্যবসার এবং জীবনযাত্রার জন্য সহজাতভাবেই টেকসই উন্নয়নের সহযোগী হয়েছে। কমপ্লায়েন্সের প্রয়োজনীয়তাগুলি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে যাতে ব্যবসাযয়িক কার্যক্রম বা উৎপাদন, এমনকি সাধারণ জীবনধারাও প্রভাবিত না হয়।
গাড়ী চালানোর সময়, সকলেই রাস্তার চিহ্ন অনুসরণ করেন; উড্ডয়নের সময় যাত্রীরা সিট বেল্ট বেঁধে রাখেন এবং নিরাপত্তার অন্যান্য নির্দেশাবলী অনুসরণ করেন; একটি পার্ক পরিদর্শন করার সময়, দর্শনার্থীরা নির্ধারিত নিয়মগুলিকে সম্মান করার জন্য ফুল ছিড়েন না; অপারেশন করার সময় ডাক্তার এবং নার্সরা মাস্ক এবং গ্লাভস পড়েন; উৎপাদন শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, পণ্যের গুণতগমান, পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করতে একটি পূর্বনির্ধারিত এবং কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
সুতরাং, কমপ্লায়েন্স হল সমস্ত নিয়ম, নীতি, প্রবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া। এছাড়া আর কিছুই নয়। নৈতিকভাবে, আইনগতভাবে, প্রযুক্তিগতভাবে এবং প্রশাসনিকভাবে আমাদেরকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থেকে দূরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কমপ্লায়েন্স।সমস্যাটা তখনই তৈরি হয় যখন কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে আপস করা হয়।
আমাদের দেশে, তৈরি পোশাক খাতে কিছু মারাত্মক ঘটনার পর আমরা ‘কমপ্লায়েন্স’ শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছি। পশ্চিমা ক্রেতারা এবং ভোক্তারা কারখানার নিরাপত্তা এবং কাজের পরিস্থিতি নিয়ে এতটাই বিব্রত ছিলেন যে কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনাগুলো এখন পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে। যেহেতু তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড, তাই ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য নন-কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরিগুলির জন্য কোনও ছাড় না দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে হয়েছিল।
সামপ্রতিক মাসগুলিতে, কমপ্লায়েন্স এর বিষয়ে আলোচনা আবার সামনে এসেছে এবং এবার এটি এমএফএস সেক্টরের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান ই-কমার্স সেক্টরের উপরও প্রয়োগের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে।
ইভ্যালি, আলেশা, ই-অরেঞ্জের মতো কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের নন-কমপ্লায়েন্ট অনুশীলন এবং একটি মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারীর দ্বারা অস্পষ্ট অপারেশন গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নীরবতার কারণে।
যদিও তারা বিভিন্ন ধারার, তবুও তাদের উদ্দেশ্য, গঠনমূলক কাঠামো, পদ্ধতি ইত্যাদির কারণে জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এটা স্পষ্ট যে কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তাদের নিজস্ব কোন আর্থিক শক্তি ছাড়াই গঠিত হয়েছিল এবং শুধুমাত্র প্রতারণার মাধ্যমে জনসাধারণের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল। গণমাধ্যম, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের পরেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থরা এখনও তাদের বিনিয়োগের রিটার্ন পাননি।
এমএফএস সেক্টরেও অস্বস্তির হাওয়া বইছে। নগদের লাইসেন্স ইস্যুটি এখনও ঝুলে রয়েছে। নগদ একটি অনাপত্তি পত্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে যা বেশ কয়েকবার পুনঃনবায়ন করা হয়েছে।
কঠোরভাবে কমপ্লায়েন্স মেনে চলার জন্য, যেকোনো এমএফএস প্রদানকারীর সম্পূর্ণ লাইসেন্স থাকতে হবে। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, নগদ এ বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের ৫১% অংশীদারিত্ব রয়েছে, কিন্তু তারা (ডাকঘর) এখনও পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ততা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যপক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট অফিস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা একটি চমৎকার উদাহরন হতে পারত।
প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন, বিশেষ করে, ডাক পরিষেবার গুরুত্ব সর্বত্রই অপ্রিয় হয়ে পড়েছে।
কোরিয়া, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ তাদের ডাক বিভাগকে আনুষঙ্গিক যোগাযোগ এবং ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যাইহোক, কোথাও এটি লক্ষনীয় সাফল্যের মুখ দেখেনি।
একটি এমএফএস প্রদানকারী হিসাবে নগদ এর আগমন প্রকৃতপক্ষে একটি দারুন খবর ছিল কারণ এটি দেশের সকলের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিশাল কাজকে যুক্ত করবে। এছাড়াও, এটি দেশে এমএফএস ধারণা এবং অনুশীলনকে জোরালো করবে। যাইহোক, এই ধরনের সমস্ত পদক্ষেপের জন্য প্রয়োাজন স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা এবং সর্বোপরি বিদ্যমান নিয়ম ও প্রবিধানের সাথে সম্পূর্ণ সম্মতি।
উদ্বোধন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই, নগদ বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রাহক পেয়েছে। কিন্তু কোম্পানী এখনও বরফের উপর হাঁটছে এবং যদি এটি চলতে থাকে তবে তারা গ্রাহকদের আস্থা হারাতে শুরু করতে পারে।
ভোক্তাদেরই সব সময় লোকসান গুনতে হয়। তারা প্রায়ই প্রতারণামূলক উদ্যোগের লোভনীয় প্রচারের শিকার হয় এবং যখন এই সংস্থাগুলি প্রতিশ্রুতি মতো সেবা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তখন ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। নৈতিক বিজ্ঞাপন হলো সঠিক বিষয় ভোক্তাদের জানানো, প্রতারণার মাধ্যমে তাদের শোষণ করা নয়।
বাংলাদেশে ডিজিটাল কমার্স এবং লেনদেনের গল্প বিশ্বজুড়ে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে কারণ এটি ব্যপক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তা করেছে এবং আর্থিক পরিষেবার সমতা তৈরিতে অবদান রেখেছে।
আমাদের ডিজিটাল যাত্রায় শ্রেষ্ঠত্বের এই উজ্জ্বল চিহ্নটি কয়েকজনের অনৈতিক ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য কোনো পরীক্ষায় ফেলা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের কোমর বেঁধে মাঠে নামতে হবে যাতে সমাজের ডিজিটালাইজেশন প্রতিষ্ঠিত প্রবিধানের সমস্ত দিক মেনে সম্পন্ন হয়, তা তত্ত্বাবধান করতে হবে।
এই নীতিগুলির সাথে আপস করা শুধুমাত্র ভোক্তাদের ক্ষতি করবে না; ডিজিটালাইজেশন প্রচেষ্টাগুলি গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হবে এবং তৈরি পোশাক খাতের দুর্ঘটনার মতো দেশের ভাবমূর্তি আবারও ক্ষুন্ন হবে। সুতরাং, সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতি নিশ্চিত করুন এবং এর সাথে আপস করার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করুন।

লেখক : প্রধান নির্বাহী, বিজকেয়ার

পূর্ববর্তী নিবন্ধকখনো কখনো ঝড়ের আঘাতে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে