হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

ভুল থেকে শিখুন : এলোমেলো ভাবনা

করিম সাহেব জীবনে অনেক ভুল করেছেন। অথচ পাশাপাশি তার প্রতিবেশী রহিম সাহেব জীবনে কোন ভুল করেননি। কীভাবে সম্ভব? ব্যাপারটা খুব সোজা। করিম সাহেব এই জীবনে অনেক কাজ করেছেন, কাজ করতে গিয়ে কিছু কিছু ভুল করেছেন, আর রহিম সাহেব জীবনে কোন কাজ করেননি, ফলে তিনি কোন ভুলই করেননি। এই প্রসঙ্গে নীল গেইমেনের কথা এসে যায়। পুরো নাম নীল রিচার্ড মেককিনন গেইমেন। বয়স খুব একটা হয়নি। জন্ম ১৯৬০ সালের ১০ নভেম্বর। সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি, হরর এবং কমিকস লিখে ইংরেজ এই লেখক ইতিমধ্যে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। পেয়েছেন বেশ কটি পুরস্কার, তার লেখা বইয়ের জন্যে। তার পরিবার পোলিশ-ইহুদী এবং ১৯১৪ সালের আগে তার দাদার-দাদা বেলজিয়ামের আনতওয়ারপেন শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসতি গাড়েন। নীল তার লেখা বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসির জন্যে ‘হিউগো’, ‘নেবুলা’ ও ‘ব্রাম স্টকার’ পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শুরুতে প্রকাশকরা তার লেখা বই প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে তিনি বেছে নেন সাংবাদিকতা। কিন্তু লেখালেখি ছাড়েননি। ব্যর্থ হতে হতে এক সময় তিনি সফল লেখক হিসাবে সমাদৃত হন। সফল হবার এমন গল্প আমরা বাংলাদেশেও বেশ কয়েক সফল-লেখকের কাছ থেকে শুনেছি। নীল গেইমেনের কথা মনে এলো নতুন বছরকে নিয়ে তার একটি ‘লেখার’ কারণে। নতুন বছরকে স্বাগতম জানিয়ে তিনি একবার লিখেছিলেন, ‘আমি আশা করি যে আগামী বছরে আপনি ভুল করবেন। কারণ আপনি যদি ভুল করেন, তার অর্থ এই আপনি নতুন বিষয় তৈরী ও নতুন বিষয় নিয়ে কিছু করবার চেষ্টা করছেন, শিখছেন, নিজেকে পরিবর্তন করছেন, পাশাপাশি পরিবর্তন করছেন আপনার পৃথিবী। আপনি এমন কিছু করছেন, যা আপনি আগে কখনও করেননি এবং যা আরো গুরুত্বপূর্ণ।’ নীল আরো লেখেন, ‘তাই আপনার, আমার এবং আমাদের সকলের জন্যে আগামী বছরের কামনা- নতুন ‘ভুল’ করুন। মহিমান্বিত, অবাক করার মত ভুল করুন, এমন ভুল করুন যা আগে কেউ করেননি। চুপসে যাবেন না, থামবেন না। এই চিন্তা করবেন না যে, এটি খুব ভাল কিছু নয় কিংবা এটি নিখুঁত নয়। সেটি যাই হোক না কেন- আর্ট বা প্রেম, কিংবা কাজ, পরিবার, হোক না বা জীবন। আপনি যা করতে ভয় পান না কেন, করুন। আপনার ভুলগুলি করুন, পরের বছর এবং সারাজীবন।’ ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে। ভুল করে থেমে না থেমে আবার চেষ্টা করুন। সাফল্য আসবেই। ভুলের কথা উঠতেই মনে পড়ে স্কুল-বয়সে এলজেব্রা করতে আমার বারবার ভুল করা, আর মেজদার কাছে ‘প্রতিটি ভুলের জন্যে আমাকে চতুস্পদ প্রাণীর (গাঁধা) সাথে তুলনা করে বকা দেয়ার কথা। হাল ছাড়তাম না। ফর্মুলা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ একটু পর একই ফর্মুলার এলজেব্রা করতে গিয়ে ভুল। ভুল করে তার কাছে গেলে বকা খাবো সেটি মনে রেখে আবার তার কাছে যেতাম। সে শুধরে দিত। এই এলজেব্রা আর জ্যামিতি মেট্রিক পরীক্ষায় আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছিল। সে যাত্রায় অংকে পেয়েছিলাম ৬৫। আমরা যারা আম-জনতা আমরা ভুল করতে ভয় পাই। ভুল হবে এই ভয়ে কিছু, বিশেষ করে চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে পিছু হটি। এই ভয়ের কারণে আমাদের অনেকের আর নিজ-পায়ে দাঁড়ানো হয়ে উঠেনা, আমরা বসেই থাকি। প্রতিটি ভুল আমাদের শেখায়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যথার্থ বলেছিলেন, ‘The only man who never does a mistake is the one who never does anything’ অর্থাৎ ‘সেই একমাত্র ভুল করেনা যে কখনো কিছু করেনা।’
মানুষ সাধারণত ব্যর্থতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন। তারা ‘ব্যর্থতাকে’ জীবন-চলার পথে ‘ডেড এন্ড’ বা ‘শেষ গন্তব্য’ হিসাবে দেখেন। তারা যে কোনো মূল্যে এটি এড়াতে চেষ্টা করেন। তারা ব্যর্থতার বিষয়ে এতটাই সতর্ক যে তারা এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন না যে, ব্যর্থতা জীবনে সাফল্য অর্জনের একটি অতি প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা। ব্যর্থতা মানুষকে ধৈর্য্য বাড়ানোর জন্য তাদের সীমা পরীক্ষা করতে ঠেলে দেয়। আপনি যদি ব্যর্থ না হন তবে সফল হওয়ার জন্য যে প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টি ও মানসিক সংকল্প দরকার তা অর্জন করতে পারবেন না। ব্যর্থতা মূলত সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবার একটি সোপান। আমরা তো জানি সেই বহুল প্রচলিত কথা ‘ফেইলুর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’ অর্থাৎ ‘ব্যর্থতা সফলতার স্তম্ভ’। না, এই সমস্ত সহজ-সরল অথচ অতি বাস্তব সত্য কথা আমার নয়। কথাগুলি আর এক লেখকের। ‘ম্যাসিভ ক্যারিয়ার সাকসেস’ শীর্ষক ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি বই থেকে উদ্ধৃত করলাম। মাস দুয়েক আগে খোদ লেখক ড. মজিবুর দফতরি হল্যান্ড এলে উপহার স্বরূপ বইটি দেন। লেখক ড. মজিবুরের সাথে বছর কয়েক ধরে পরিচয়, জানাশোনা এন্ড বন্ধুত্ব। স্থায়ীভাবে থাকেন ফিনল্যান্ড। বার কয়েক হল্যান্ড এসেছিলেন সম্মেলনে যোগ দিতে। সেই থেকে পরিচয়। বন্ধুবৎসল, সহজে অচেনাকে কাছে টেনে নিতে পারেন, বন্ধু করে নিতে পারেন তিনি। খুব সম্ভবতঃ ফিনল্যান্ডে তিনি প্রথম বাংলাদেশী যিনি সেখানকার মূলধারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকির গ্রীন পাটির্র নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মাস কয়েক আগে। এছাড়া সমপ্রতি একই দলের ইমিগ্রেশন পলিসি কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ড. মুজিবর। মূল ধারার রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা খুব বেশি দিনের নয়। লেখালেখির পাশাপাশি গবেষনা ও নানা সম্মেলন, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার কাজও করে থাকেন। ক্রিস্টমাস, বছরের শেষের দিক, কিছুটা অবসর নিত্য কাজ থেকে। আর এই সুযোগে ক’দিন ধরে লন্ডনের পাওয়ার হাউস পাবলিকেশনস থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত ড. মুজিবরের লেখা বইটি পড়ছিলাম। বেশ সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা বইটি পড়তে বেশ ভালো লাগছিল। এমন না যে সেখানে লেখা সব তথ্য নতুন। গতকাল দেখি আমার ২০ বছরের আত্মজ, অতীশ টেবিলে রাখা বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচড়া করছে। তাকে বলি, ‘সময় করে বইটি পড়। তোমাদের জন্যে বিশেষ করে তোমরা যারা ‘ক্যারিয়ার’ গড়া নিয়ে ব্যস্ত তোমাদের জন্যে অনেক সাজেশন ও গাইড লাইন আছে।’ বইটি পড়তে গিয়ে কয়েক স্থানে বেশ মজা পেলাম, যা ইংরেজি বইয়ে সাধারণত দেখা যায়না। লেখক বাঙালি হওয়ায় বইয়ে উদাহরণ টানতে গিয়ে ড. মুজিবর বাংলায় প্রচলিত বেশ কিছু গল্প ও কথা টেনে এনেছেন। যেমন এক স্থানে আছে, চিলে কান নিয়েছে শুনে না দৌড়ে আগে দেখুন বিষয়টা কি, কিংবা কোনকিছু করার আগে কী ফল হবে এই ভেবে গড়িমসি করা প্রসঙ্গে তিনি এক জায়গায় কী ভাবে সাঁতার শিখেছেন তার উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, আমার বাবা আমাকে পুকুরের পানিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই ছোটবেলায়। গৌতম বুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এনে এক স্থানে লিখেছেন, ‘বুদ্ধ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে আমরা যে কষ্ট পাই তা আমাদের অজ্ঞতার কারণে কিংবা আমাদের নিজের এবং চারপাশ সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের জন্যে। অতীতের নেতিবাচক বা মন্দ-স্মৃতির প্রসঙ্গে তিনি লেখেন- অতীতে ঘটে যাওয়া খারাপ বা কষ্টকর ঘটনা বা স্মৃতিগুলির ‘ব্যাগ’ সামনের দিনগুলিতে বহন করার কোন অর্থ হয়না। তাতে ভালো কোন কিছু প্রাপ্তি হয়না, প্রাপ্তি যা হয় তা হলো ঘুম-হারাম, শান্তি হারাম। কেউ আপনার মনে কষ্ট দিয়েছন বা ক্ষতি করেছেন, আপনি কী করবেন? প্রতিশোধ নেবেন? তাহলে সেই মন্দ ব্যক্তির সাথে আপনার তো আর কোন পার্থক্য রইলোনা। কাছের কেউ যদি কোন কারণে আপনাকে ভীষণ আঘাত দিয়ে থাকেন, তিনি যদি আপনার সম্পর্কে মন্দ বলে বেড়ান, তাহলে তার সাথে কাটানো ভালো দিনগুলি, সুখের মুহূর্তগুলির কথা ভাবুন। দেখবেন তার প্রতি আপনার যে বিদ্বেষ, যে রাগ তা ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে যাচ্ছে। আপনি এক ধরণের প্রশান্তি লাভ করছেন। রবার্ট মুলারের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা।তিনি বলেছিলেন- ‘ক্ষমা করা হলো ভালোবাসার সর্বোচ্চ সুন্দর রূপ। বিনিময়ে আপনি পাবেন অবর্ণনীয় শান্তি ও সুখ’।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোবাইল আর্থিক সেবা শিল্পে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত জরুরি, আপস কাম্য নয়!
পরবর্তী নিবন্ধমাননীয় প্রধানমন্ত্রীর থেমে না থাকার ব্রত