ভরণ–পোষণ হচ্ছে মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা।
মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন মেয়ে বিয়ের আগ পর্যন্ত বাবার কাছ থেকে ভরণ–পোষণ দাবি করতে পারে। বিয়ের পর স্বামী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবে।
মুসলিম বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। এই চুক্তির ফলে স্বামী–স্ত্রী একত্রে বসবাস ও সংসার পালন করেন। বিয়ের ফলে কিছু আইনগত অধিকার যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি কিছু দায়িত্বও সৃষ্টি হয়। এই দায়িত্বগুলোর মাঝে ভরণপোষণ অন্যতম।
একজন সক্ষম এবং উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার স্ত্রী, নাবালক ছেলে–মেয়েদের ভরণ–পোষণ দিতে সবসময়ই বাধ্য।
ভরণ–পোষণ হচ্ছে স্বামীর জন্য দায়িত্ব এবং স্ত্রীর জন্য অধিকার। বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য থাকা–খাওয়া, পোশাক–পরিচ্ছদ, চিকিৎসা ও জীবন ধারণের জন্য অন্যান্য যে যে উপকরণ লাগবে স্ত্রী তা স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী হন। এই অধিকার স্ত্রী যখন স্বামীর সঙ্গে বিবাহ–বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে তখন তো থাকবেই, তেমনি কোনো কারণে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে বিবাহ–বিচ্ছেদের পরেও তা বলবত থাকবে।
তবে বিবাহ–বিচ্ছেদের পরে এটি একটি সীমিত অধিকার এবং সীমাবদ্ধ সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। মুসলিম আইনে স্ত্রীর উপর স্বামীর ব্যাপারে কিন্তু একই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। কারণ ধরেই নেয়া হয় যে, বেশিরভাগ মেয়েরা বাবা বা স্বামীর ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল। যদিও বতর্মানে বাস্তবতা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে কারণেই স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণ–পোষণ পাবেন কিন্তু স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে কোনো ভরণ–পোষণ পাবেন না।
মুসলিম আইন অনুযায়ী স্ত্রী চাকরি করলে, চাকরি ক্ষেত্রে একইরকম সুযোগ–সুবিধা পেলেও স্ত্রী–কে ভরণ–পোষণ দেয়া পুরুষের পক্ষে আইনত বাধ্যতামূলক।
বিবাহ–বিচ্ছেদের পরে ভরণপোষণ
যদি কোনো কারণে স্বামী–স্ত্রীর মাঝে বিবাহ–বিচ্ছেদ ঘটেই যায় তাহলে বিবাহ–বিচ্ছেদের পরও স্ত্রী কিছুদিন ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। যেদিন থেকে বিবাহ–বিচ্ছেদ কার্যকরী হয় সেদিন থেকে ৯০ দিন।
ভরণপোষণ আদায়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীর আইনগত যে অধিকার
আইনসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামী তার স্ত্রীকে অবহেলা করলে বা তার ভরণ–পোষণ প্রদান করতে অস্বীকার করলে স্ত্রী তার নিজ ভরণ–পোষণের দাবিতে স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা পর্যন্ত দায়ের করতে পারে।
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভরণপোষণের জন্য স্ত্রীর মামলা করার অধিকার আছে। এটি একটি দেওয়ানি প্রতিকার। এই অধ্যাদেশে ভরণ–পোষণ, দেনমোহর, বিবাহ–বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করার কথা বলা হয়েছে। পূর্বে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮৮ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভরণ–পোষণের মামলা দায়ের করা যেত। ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে এই ধারাটি বাদ দেয়া হয়েছে। (সূত্র : বাংলাদেশ গেজেট, ৮ এপ্রিল ২০০৯)।
তাছাড়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৯ ধারায় বলা আছে, স্বামী স্ত্রীকে ভরণ–পোষণ দিতে ব্যর্থ হলে স্ত্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে এই বিষয়ে আবেদন করতে পারবেন। চেয়ারম্যান সালিশি পরিষদ গঠন করে ভরণ–পোষণের পরিমাণ ঠিক করবেন এবং সার্টিফিকেট ইস্যু করবেন। স্বামী এরপরেও নির্ধারিত ভরণ–পোষণ না দিলে স্ত্রী বকেয়া ভূমি রাজস্বের আকারে তা আদায় করতে পারবেন।
আইনে বলা হয়েছে, যদি স্ত্রী কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামীর কাছ থেকে আলাদা বসবাস করেন সেক্ষেত্রে স্বামী তাকে ভরণ–পোষণ দিতে বাধ্য না। তবে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে আলাদা বসবাস করলে স্বামী ভরণ–পোষণ দিতে বাধ্য।
খোরপোষের পরিমাণ কত হওয়া উচিত, এর পরিমাণ কত হবে তার কোন স্ট্যান্ডার্ড ফর্মুলা বা অংক নেই। অভিজ্ঞতা ও উচ্চাদালতের পূর্বের অনুসরণীয় রায়ের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে একজন স্ত্রীর খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান ভরণ–পোষণের অন্তর্ভুক্ত। তবে শুধুমাত্র একজন সাধারণ ব্যক্তির খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান বা মৌলিক চাহিদার কথা চিন্তা করলেই হবে না। এক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা বিবেচ্য হবে। এই পরিমাণ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে বিজ্ঞ আদালত স্ত্রীর পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা, জীবন ধরনের মৌলিক চাহিদা, স্বামীর আয়, ব্যয়, সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করতে পারবেন।
মোদ্দা কথা, মুসলিম আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, স্বামী যদি অসুস্থ হয় বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় বা স্ত্রীর থাকেও তবুও স্বামীকেই স্ত্রীর ভরণপোষণ প্রদান করতে হবে। সাধারণত একজন স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে পিত্রালয়ে বসবাস করলে স্বামীর সাথে স্ত্রীর বসবাসের দায় চূড়ান্ত নয়। অর্থাৎ স্ত্রীকে স্বামীর সাথে সর্বাবস্থায় বসবাস করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আইনে এমন কতগুলো অবস্থাকে স্বীকার করা হয়েছে, যে অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর সাথে বসবাস না করেও ভরণ–পোষণ পাবে।
যেমন :
* যদি স্বামী অভ্যাসগতভাবে স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে।
* যদি স্বামী সুদীর্ঘকাল স্ত্রী থেকে দূরে থাকে।
* যদি স্বামী তার বাড়ি থেকে স্ত্রীকে চলে যাবার নির্দেশ দেয়।
* যদি স্বামী স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেয়।
* যদি স্বামী প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করে।
উপরিউক্ত সর্বাবস্থায় স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণের অধিকারী। তবে স্ত্রী যদি চাকরি করেন এবং স্বেচ্ছায় সংসারে কনট্রিবিউট করতে চান তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু জোর করে বা কায়দা বের করে স্ত্রীর অর্থ হস্তগত করা যাবে না।