নারীর অসহায়ত্ব, নারীর অধিকার

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ৬ মে, ২০২৩ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

একজন নারী স্বামী মারা যাবার পর কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারেন, কতটুকু অধিকার নিয়ে চলাফেরা করতে পারেন, লোকসমাজে তার মূল্যায়ন কতটুকু হয়, তা অনেক সময়ে আমরা ভাবি না। আইন আছে অনেক। কিন্তু সে আইনের ধারাবাহিকতা বহন করার মতো শক্তি, মনোবল, জনবল বিধবা নারীর কতটুকু থাকে? এটা ভাববার বিষয়।

মুসলিম নারী বাবার সম্পত্তি থেকে আর স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি পায়।

প্রথমত, নারী যেটুকু সম্পত্তি পায়, তার ওপর নিজের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, যেমন ধরুন আমার মা, উত্তরাধিকার সূত্রে যতটুকু সম্পদ পেয়েছিলেন, ভোগ করতে পারেন নাই। সেগুলো তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি তা হলো সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলে নারীকে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় কিনা।

সম্পত্তি কতটুকু বেশি থাকলে বিধবা নারীটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারেন, এটাও একটা প্রশ্ন।

মুসলিম আইনে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার হকদার হলে একজন নারী স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারেন। আবার কর্মক্ষম সন্তান থাকলে তাঁদের কাছ থেকে আইনত তিনি ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন। একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর প্রাপ্য অংশ যে কারও কাছে বিক্রি করতে পারেন কিংবা যে কোনোভাবে হস্তান্তর করতে পারেন।

বাবামা যেন সন্তানের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সেজন্য রয়েছে আইন। সব বাবামা সন্তানের মঙ্গল চান। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয়কোনো সন্তান বাবামাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তা হলে তারা আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন।

একজন বিধবা স্ত্রী স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির সন্তান থাকা অবস্থায় ১/৮ অংশ (একঅষ্টমাংশ) পাবেন এবং সন্তান না থাকলে ১/৪ অংশ (একচতুর্থাংশ) পাবেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তি তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

এইসব কথা হলো আইনের।

আমি এই আইনের কথাগুলো বললাম কারণ আইন আছে, কিন্তু এটা খুব সহজভাবে পাওয়া যায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে আদায় করতে হয় সম্পত্তি বা ভরণপোষণ।

খুব কাছ থেকে দেখা, একজন স্মার্টসুন্দরীরুচিশীল আধুনিক মহিলার টানাপোড়েনের গল্প।

নারীর নাম ধরুন জান্নাত। তার বর তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী, আত্মীয় হোন। মাবাবার চাপে একেবারেই অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো কিছু বুঝবার আগেই। সুপাত্র, সুদর্শন এমন পাত্র হাতছাড়া করা যায় না। লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারলেন না জান্নাত। স্কুলের গন্ডিও পেরোতে পারেননি।

তবে বেশ ভালই চলছিলো তাদের সংসার। ভদ্রলোক সরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা। দুই সন্তানের জনকজননী তারা। ধীরে ধীরে সংসারে বড় হচ্ছে ছেলেমেয়ে। মেয়ের বিয়ে হলো সুপাত্রের সঙ্গে। পুত্রবধূও এলো ঘরে। ভদ্রলোকের নানান অসুখ দেখা দিলো বয়সের সাথে সাথে। জান্নাত বড় হতে হতে বুঝতে পারলো সংসারে তার সব আছে। শুধু মনের ভাব বুঝবার কেউ নেই। তাঁর সব ইচ্ছে বিসর্জন দিতেদিতে সংসারের ভারে ন্যুজ হলো সে। স্বামীছেলেমেয়ে আর সংসারই হলো তার একমাত্র ভরসা।

জমি যা ছিলো সব বিক্রি করে সেটাকায় সংসার চলে, চিকিৎসা চলে। নারীর কতোরকমের চাহিদা থাকে। কত স্বপ্ন থাকে তার কিছু পূরণ হয়, আর বেশিরভাগ অপূর্ণতাই রয়ে যায়।

জান্নাতের ছেলে বউ নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমালো। মেয়ে অন্যদেশে। একা পথ চলতে গিয়ে শারীরিক, মানসিক চাপে জান্নাতেরও নানান অসুখ দেখা দিলো। স্বামীর সেবায় রাতদিন পার করে দিলো ঐ বাড়িতেই। নিজের যত্ন, স্বাদ, আহ্লাদ কিছুই আর করতে পারলেন না।

স্বামী মারা গেলেন এক রাতে এই বছরখানেক হলো সবে। দাফন শেষ করে চারদিনের মাথায় বাড়ি ছেড়ে, ফার্নিচার সব বিক্রি করে মাকে অন্যবাড়িতে রেখে চলে গেলেন সন্তান। জান্নাতের ইচ্ছে কি ছিলো, সে কি এই বাসায় থাকতে চাইছে কিনা, কোনটাই জানতে চায়নি পরিবারের কেউ। তার মনের ভাব প্রকাশ করার মতো মনমানসিকতাও হারিয়েছে তখন। এতো দ্রুত তাঁর জীবনে এমন ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে তা ভাবতেও পারেননি।

যত দিন যাচ্ছে অন্যের বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। অথচ এই জান্নাতের ভরপুর সংসার ছিলো। সাজানো সংসার পরিপাটি করে গুছানো ছিলো। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতো। ঘরই ছিলো তাঁর একান্ত আপন। অথচ কিছু বুঝবার আগেই তাকে সব ছেড়ে ছুড়ে অন্যখানে চলে আসতে হলো।

কিছুদিন যাবার পর জান্নাত জানতে পারলো তার স্বামী ব্যাংকে যে টাকা জমা রেখেছে তার ভাগ ছেলেমেয়ের নামে। জান্নাতের জন্যে কিছুই রেখে যায়নি। মায়ের বাড়ির একেবারেই অল্প ঘর ভাড়া পায় সে। এটা দিয়ে সে ইচ্ছে করলেও বাড়িভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে না। খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা।

অল্প বয়সে যে মেয়েটার কাঁধে সংসার নামক বোঝা চাপানো হলো তাঁর দায় তার মা, বাবা, পরিবারকে নিতে হবে। লেখাপড়া না জানা জান্নাতের সংসার করা ছাড়া আর কোন গতিই ছিলো না।

নানান কটু কথার ঝামেলায় পড়ে একদিন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।

আত্মহত্যা মানে একটি সুন্দর জীবনের করুণ, অনাকাঙ্ক্ষিত অকাল মৃত্যু। আত্মহত্যা একটি আত্মধ্বংসী সিদ্ধান্ত। যা ঘটে গেলে সে জীবন ফিরে পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই।

পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশেই মৃত্যুর প্রথম দশটি কারণের মধ্যে আত্মহত্যা একটি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে এক জন।

একটা মানুষ কখন মরতে চায়? যখন তার চারপাশে মায়ার অভাব দেখা দেয়, ভালোবাসার অভাববোধ করে। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গ থাকা কতটা কঠিন তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানেন।

ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে সবার অজান্তে তিলে তিলে শেষ করে দেয়।

মানুষের শারীরিক মানসিক কর্মক্ষমতা মারাত্মক কমিয়ে দেয় এই ডিপ্রেশন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লাখ) ডিপ্রেশনএর রোগী রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন।

ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে আক্রান্ত রোগীরা নীরবেনিভৃতে আত্মহত্যা করে বসেন। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। ডিপ্রেশন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যা থেকে তারা আত্মহত্যা করে বসেন।

সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকা, উৎসাহ উদ্যম হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিঃস্ব অপাঙক্তেয় মনে করা, অযাচিত অপরাধবোধ, আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা। নিজের মতো করে চলতে না পারা, সবসময়েই কারো না কারো উপর নির্ভর থাকা, আবার এসব কারণে নানান কথাও যখন শুনতেই হয়, তখন তার ভিতরে একধরনের চাপা কষ্ট অনুভব করে। আর তখনই এই পৃথিবীকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হয়। কাছের মানুষগুলোর সহযোগিতা না পাওয়াই মানুষ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

এই লক্ষণগুলো টানা দু’সপ্তাহের বেশি থাকলে তাকে মেজর ডিপ্রেশনের রোগী বলে, এবং তিনি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন বলা যায়। তার পরিবারের দায়িত্ব তাকে চিকিৎসা দেয়া। সেবাশুশ্রূষা করে আনন্দে রাখা।

নয়তো এই বয়সে এসে একটু আন্তরিকতার, একটু মায়া, ভালোবাসার অভাববোধে একজন নারী তার সবচেয়ে সুন্দর জীবন শেষ করে দেয়!

আজ যদি স্বামী টাকাটা জান্নাতের নামে রেখে যেতো, তাহলে সে পূর্ণপ্রাণে বাঁচতে পারতো। অর্থ অনর্থের মূল এই কথাটা এখন আর এইভাবে মেনে নেয়া যায় না। অর্থের কাছে সবই পরাজিত। অর্থই শক্তি।

আইনে আছে বিধবা নারীর সম্পত্তির কথা। কিন্তু কতটুকু পেলে একজন নারী ভালোভাবে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে এটা জানা নেই। যাদের সম্পত্তি কম তার ভাগও কম পায়। সে বাবার সম্পত্তি হোক বা স্বামীর দেয়া সম্পত্তি।

একজন নারী আইনি সম্পত্তি যাই পাক না কেন সেযেন পরিপূর্ণতায় কারো তোয়াক্কা না করে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারার জন্য স্বাবলম্বী হতে পারে। যেসংসারে সে নিজেকে সমর্পণ করে, সেসংসারের অধিকর্তার বিবেচনা বোধ যেন সক্রিয় হয়।

বঞ্চিত হলে অনেক নারীরই আর বাঁচার স্বাদ আর থাকে না। সবকিছু ধুসর গোধূলীর শেষ বিকালের মতো মিলিয়ে যায়। পৃথিবী মায়ায় বাঁচুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুসলিম আইনে নারীর ভরণ-পোষণ
পরবর্তী নিবন্ধআদালতে ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন ট্রাম্প