মুজিবনগর সরকার : ইতিহাসের মাইলফলক

বাসুদেব খাস্তগীর | বুধবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে জন্ম নিয়েছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই ঘটনা পরম্পরায় পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। সেই অভ্যুদয়ের পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং ছিল নানা সংগ্রাম ও রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় ১৯৪৭ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ নেতৃত্ব দেবার সব গুণাবলি ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে পরিস্ফুটিত হকে থাকে নানা ঘটনা পরম্পরায়। বাঙালি জাতির মুক্তির যে ইতিহাস সে ইতিহাস তাঁকে ঘিরেই বারবার আবর্তিত হয়েছে। সেই ১৯৪৭ সালেই তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা হিসাবে। একটি রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা থেকেই ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। যাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, উচ্ছ্বাস, আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যার ছিল মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্ত করা। তাই সেদিন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু কখনো আত্মগোপন করেননি। পৃথিবীর অনেক বড় বড় নেতাদের আত্মগোপন করার ইতিহাস আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। মৃত্যুক হাতের মুঠোয় রেখে তিনি ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ কালরাত্রিতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাননি। দেশ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, মানবিকতা ও প্রচণ্ড সাহসিকতার অসামান্য ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার ধনীগরিব, কবিসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের হৃদয় করতে পেরেছিলেন তাঁর ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব গুণের কারণেই। তাই বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা। তাঁরই আহ্বানে ১৯৭১ সালে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছে এবং শত্রুর কাছে থেকে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হানাদারশত্রু বিতাড়িত করার একটি যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমাদের নয় মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রুদের বিতাড়িত করতে। অর্থাৎ এ শত্রু বিতাড়িত করতে আমাদের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী নানা অপপ্রচার চালিয়েছে। সেই অপপ্রচারের একটি কৌশল ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসাবে বিশ্বে তুলে ধরা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে সেই তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী অপ্রচার থেকে সুকৌশলে বেরিয়ে এসে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ এর ১৩ জুলাই পাকিস্তানের করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির তৎকালীন (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন ‘তেহরানে আমি স্পষ্টতই বলেছি আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়, আলোচনা হবে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। আমরা সরকারকেও স্পষ্টতই এই বার্তা দিতে চেয়েছি। কিন্তু এই নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার প্রথম থেকেই অবাস্তব মনোভাব পোষণ করে এসেছিলাম। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাতীয় পরিষদকে দুটো কমিটিতে বিভক্ত করার কথা বলেছিলেন তখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে আওয়ামী লীগকে বারবার শোধরানোর সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনার সঙ্গে আমরা বলেছি জাতীয় পরিষদ বলবৎ থাকবে। জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ শুধু তারাই হারিয়েছেন যারা কেবল আওয়ামী লীগ ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত।’ ভুট্টোর এ কথায় প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনকে তিনি কীভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। সেই রাজনৈতিক কূটচালের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায় সহজ ছিল না। এই প্রচেষ্টা পাকিস্তানিরা অনেক আগে থেকেই করে আসছিল। সেই দুর্যোগ মুহূর্তে সেই প্রশ্নের জবাব দিতে একটা সরকার ব্যবস্থার ঘোষণা দেয়া জরুরি ছিল। সেই সময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নামক অপপ্রচার থেকে বেরিয়ে আসার একটি মোক্ষম জবাব। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেয়া হয়নি। সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠন করা হয় এই সরকার। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন পাকিস্তান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের কাছে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে মরিয়া ঠিক তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতারা একটি স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি করেছিলেন এবং সেই ইশতেহার ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ভূমিতে খুব প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তাঞ্চল। সেদিনের কুষ্টিয়াঞ্চল ছিল সেই ভুমি সে রকম একটি মুক্তাঞ্চল।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার (তৎকালীন কুষ্টিয়া) বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। যে সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। এই মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়েছিল ১০ই এপ্রিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন) এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। সেই মন্ত্রিপরিষদে আরো ছিলেন এম মনসুর আলী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয়েছিল। এ ভাষণের কারণে দেশবিদেশের মানুষ জানতে পারে, বাংলাদেশে একটি আইনসম্মত সরকার গঠিত হয়েছে। স্বাধীনতাকামী বাঙালির আন্দোলনকে পাকিস্তান সরকার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে যে অপপ্রচার করেছিল সেই অপপ্রচারে এই সরকার সমস্ত প্রশ্নকে দূরে ঠেলে দেয়। এ সরকারের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ ও এ সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যদি এ সরকার গঠিত না হতো তা হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে যাত্রা সে যাত্রার গতিপথ কোথায় গিয়ে থামতো বলা মুস্কিল। তবে একথা বলা যায় স্বাধীনতাকামী বাঙালির আন্দোলনকে পাকিস্তান সরকার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার করছিল তার সঠিক জবাব দেয়ার জন্য মুজিবনগর সরকার সে অপপ্রচারকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে মুক্তিযুদ্ধকে আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছিল।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম। প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ