দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ভিক্টোরিয়া পার্কে ঘোরাঘুরির আমেজ শরীর জুড়ে। যেনো এখনো সেই ছায়াসুশীতল পার্কে এলোমেলো ঘুরছি। শরীর এবং মননে খেলা করছে পার্কের আবহ। মগজে কিলবিল করছে পার্কের তাজা স্মৃতি। এতো সুন্দর করেও কোন পার্ক গড়ে তোলা যায়! কোন দক্ষ শিল্পীর যাদুকরি শিল্পকর্মের মতো এমন সুন্দর করেও গড়ে তোলা যায় বনবনানী, খেলার মাঠ! অবসর বিনোদনের রকমারি আয়োজনের পরতে পরতে রয়েছে দক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়া! পাখির কলকাকলী যেনো শহরের ভিতরে গড়ে তোলা পার্কটিকে ভিন্ন একটি মাত্রা দিয়েছে। পার্কটি কী আসলেই শহরে, নাকি পার্কটিকে ঘিরে শহর গড়ে উঠেছে? প্রশ্নটি মনে ঘুরপাক খেলেও উত্তর পাওয়া সহজ ছিল না। আমার বন্ধু স্বপনকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, এটি তো অনেক আগে থেকেই এখানে রয়েছে। তবে একশ’ বছর আগে যখন সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে এটির যাত্রা শুরু হয়েছিল তখন এলাকায় শহর ছিল কিনা তা আমি জানি না। ওই সাইক্লোন শেল্টারটিকেই পরবর্তীতে পার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দিনে দিনে পার্কের জৌলুশ বাড়ানোর জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সাগর ভরাট করে ভূমি রিক্লেম করা হয়েছে, পার্কের আকার বেড়েছে, আকৃতি পাল্টানো হয়েছে। সাগরের কুল ঘেঁষা পার্কটির জৌলুশ বাড়ার সাথে সাথে পুরো এলাকাটির জৌলুশেও চাকচিক্য এসেছে। একসময় কিছু না থাকা এলাকাটি এখন ধনে জনে ভরপুর!

পার্কের নানা কিছু রোমন্থন করতে করতে মার্কেটের ভিতরে হাঁটছিলাম। থরে থরে সাজানো নানা পণ্যের বিশাল সম্ভার দোকানে দোকানে। কিন্তু এসব আমাকে টানছিল না। ইচ্ছে করছিল আবারো ভিক্টোরিয়া পার্কে চলে যেতে। গাছের ছায়ায় বসে থাকতে, কিংবা দারুণ নান্দনিকতায় বানানো টুলে হেলান দিতে। কী সুন্দর এক একটি গাছ, কী সুন্দর এবং আয়েশি বসার জায়গা। খোলা মাঠে সবুজ ঘাসে বসে আড্ডা পিটানো কিংবা বাদাম টিপানোর এমন সুযোগ খুব বেশি জায়গায় থাকে না।

বন্ধু স্বপন আমার হাতে চাপ দিল। বললো, কিছু কিনবি? আমি মাথা নাড়লাম। দরকার নেই। সবই আমাদের দেশে আছে। বিদেশে এসে ডলার খরচ করে শপিং করতে আমার কখনো ভালো লাগে না, মন সায় দেয়না। তাই হংকংয়েও দেবে না। স্বপনকে বললাম, ঘুরে ফিরে দেখলে হবে। যদি পাওয়া যায় তাহলে একটি কফি খাবো। স্বপন হাসলো। বললো, পাওয়া যাবে মানে! অবশ্যই পাওয়া যাবে। হংকংয়ের প্রতিটি বড় মার্কেটেই ফুডকোর্ট রয়েছে। তুই যা খেতে চাস সবই পাবি। তবে বাংলা খাবার পাবি না। সেটা তোকে বাসায় খাওয়াবো।

মার্কেটটিতে লিফট রয়েছে। রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। লিফটে না গিয়ে আমরা চলন্ত সিঁড়ির দিকে গেলাম। চলন্ত ওই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। একটির পর একটি চলন্ত সিঁড়ি। একটি থেকে নেমে একটু ঘুরে অপরটি। এই যেন একটি খেলা, ছোটাছুটির খেলা। কত তলায় যে উঠলাম কে জানে! তবে বেশ কয়েক তলা যে উঠেছি তা সিঁড়ি চড়ার খেলার ধরণ থেকেই বুঝতে পারছিলাম। পুরো ফ্লোর জুড়েই খাবারের দোকান। দোকানগুলো ছোট ছোট। এসব দোকানে ক্যাশে বা কাউন্টারে একজন মাত্র মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, পেছনে কিচেন বা খাবার তৈরির ব্যবস্থা। সেখানেই তৈরি হয় খাবার। প্রতিটি দোকানেই সাঁটানো বাহারী সব খাবারের পোস্টার। অপরিচিত খাবারগুলোর অধিকাংশই অচেনা, স্বাদ গন্ধ কিছুই আমার বুঝার বা জানার কথাও না। খাবার এবং কফির দারুণ গন্ধ মৌ মৌ করছিল। পুরো ফ্লোরটি ভরে ছিল। সামনে খোলা চত্বরের মতো জায়গায় টেবিল চেয়ার পাতা। ছোট্ট দোকানটির কাউন্টারে দাঁড়ানো ছেলে বা মেয়েটিকে অর্ডার দিলে তারা খাবার তৈরি করে দেয়। সেল্ফ সার্ভিসে খাবার নিতে হয়। খোলা চত্বরে সারি সারি সাজানো চেয়ার টেবিলে বসে খাবার খাবারগুলো খাওয়া যাবে। চেয়ার টেবিলগুলো কমন, প্রতিটি দোকানের। আপনি যে দোকানের খাবারই কিনেন না কেন, এসব চেয়ার টেবিলে বসে খেতে পারবেন। চেয়ার টেবিলগুলোতে শুধু খাবার খাওয়াই নয়, ইচ্ছে করলে বসে আড্ডা দেয়া যাবে। অনেকেই দেখলাম খালি টেবিল সামনে নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ কেউ প্রেম ট্রেমও করছেন বলে মনে হলো। টেবিলে টেবিলে জোড়ায় জোড়ায় এবং দলবদ্ধ যুবক যুবতীর চুপিচুপি আলাপের পাশাপাশি দারুণ হল্লাও চলছিল।

দারুণ সুন্দরী এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে একটি দোকানে। তার হাসিতে যেনো মুক্তো ঝরছিল। বয়কার্ট চুলে দারুণ স্মার্ট লাগছিল মেয়েটিকে। কফির গন্ধটাও কেমন যেনো ভারি মনে হচ্ছিল। বন্ধু স্বপন দোকানটির কাউন্টারে গিয়ে দুইটি কফির অর্ডার করলো। প্রি পেইড। মেয়েটি স্বপনের কাছ থেকে কফির দাম বুঝে নিয়ে একটি ডিভাইস দিলো। ইলেক্ট্রনিঙ টোকেন। আমাদের কফি তৈরি হলে এই ডিভাইজটিতে রিং বাজতে থাকবে। তখন আমাদেরকে গিয়ে কফি তুলে নিতে হবে। সেল্ফ সার্ভিস। এতো ব্যয়বহুল শহরে যেখানে ঘরের কাজ করার কিংবা গাড়ি চালানোর ড্রাইভার নেই শতকরা নব্বই জন নাগরিকের। সেখানে কফির কাপ বহন করে টেবিলে দেয়ার মতো ওয়েটার রাখা বিলাসিতা। তাই তারা নিজের কাজ নিজেই করে।

মুখোমুখি বসে আমরা গল্প করছিলাম। আড়চোখে দেখছিলাম আশপাশের তরুণ তরুণীসহ হল্লায় মেতে থাকা মানুষগুলোকে। কেউ কেউ বেজায় খাওয়া দাওয়া করছিলেন। এক ব্যক্তিকে দেখলাম বেশ ঢাউশ সাইজের তিনটি বার্গার নিয়ে বসেছেন। একটি একটি করে ওই ব্যক্তি তৃতীয় নম্বর বার্গারেও কামড় বসালেন। পাশের টেবিলে দুজনকে দেখলাম স্যুপ খাচ্ছেন। স্যুপের ভিতরে কত কিছু যে মিশানো হয়েছে! ঘাস লতা পাতা সবই যেনো রয়েছে স্যুপের পানিতে। আধা সেদ্ধ ঘাস এবং লতাপাতা দিব্যি খেয়ে চলছেন লোকটি। অন্য টেবিলে দেখলাম বেশ বড়সড় আস্ত একটি হাঁস কিংবা মুরগী নিয়ে দুজন টানাটানি করছেন। আধা সেদ্ধ কিনা জানি না, তবে পোড়া পোড়া মনে হচ্ছিল। আমাদের বিয়ে বাড়িতে বর কিংবা বেয়াইয়ের টেবিলে দেয়া রোস্টের আদল, তবে দেখতে অন্যরকম। মুরগি কিংবা হাঁসের গতর থেকে মাংস কেটে নিয়ে সসে চুবিয়ে তারা বেশ খোশমেজাজে খাচ্ছিলেন। তাদের হাসি হাসি মুখের আনন্দময় আলাপনই বলে দিচ্ছিলো যে, খাবারটি ভালো হয়েছে। সুখী সুখী মুখে দুই তরুণতরুণী পুরো মুরগী কিংবা হাঁসটির হাড্ডিসহ সাবাড় করে দিচ্ছিলেন।

স্বপনের হাতে থাকা ডিভাইজটির রিং বাজতে শুরু করলো। অর্থাৎ আমাদের কফি রেডি। স্বপন আমাকে বসতে বলে কাউন্টারের দিকে চলে গেলো। একটু পরই সে ছোট্ট একটি ট্রেতে দুই মগ কফি নিয়ে ফেরত আসলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে মনে হলো, এই কফিটির জন্যই বুঝি অনেকক্ষন পরান আনচান করছিল।

কফির সাথে একটি করে বিস্কিট দেয়া হয়েছে। ছোট্ট একটি কুকিস। এটি প্রায় সব জায়গায় কফির সাথে দেয়। কুটুস কুটুস করে কুকিসটি খেয়ে অতপর কফি খাওয়া যেনো অঘোষিত নিয়ম। খালি পেটে কফি না খাওয়ার জন্যই অনেকেই শুরুতে বিস্কিটটি খেয়ে তারপর কফি খান। আবার কেউ কেউ এই বিস্কিটটি খানই না, প্লেটে পড়ে থাকে।

চলন্ত সিঁড়ি ধরে নেমে আসছিলাম। একটি ফ্লোরে এসে স্বপন আমার হাত ধরে সিঁড়ির বিপরীত দিকে নিয়ে গেলো। বললো, আয়, একটু ঘুরে দেখি। আমার তো আসলেই কোন কাজ নেই। ঘুরতে ভালোবাসি। তাই কোথাও যেতে বললে, না করি না। হাঁটতে শুরু করলাম।

স্বপন দোকানে ঢুকে কি যেনো বললো। স্বপন বেশ কয়েকবছর ধরে হংকংয়ে থাকে। এতে করে হংকংয়ের ভাষার উপর তার দক্ষতা বেশ চোখে পড়ছিল। যেখানে সেখানে সে বেশ কিচিরমিচির করতে পারছিল। স্বপনের কথা শুনার পর লোকটি অনেকগুলো শার্ট বের করলো। স্বপন আমার গলার সাইজ কত জানতে চাইলো। আমি দোকানির দিকে তাকিয়ে বেশ শব্দ করে ‘সরি’ বললাম। স্বপনকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে আসলাম। বললাম, ‘দোহাই তোর, শার্ট কিনিস না, দরকার হলে আরো এক কাপ কফি খাওয়া। শুধু শুধু আমার বোঝা বাড়িয়ে অত্যাচার করিস না।’ শার্ট না নিলে অন্য কিছু নে। জোর করলো স্বপন। আমি তাকে টেনে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলাম। সেটি তখন নিচের দিকেই যাচ্ছিল।

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুকুমার শিশু পাঠাগার
পরবর্তী নিবন্ধমুজিবনগর সরকার : ইতিহাসের মাইলফলক