মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সমাজ

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী | শনিবার , ৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

আমাদের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সর্বপ্লাবী ঘটনা যা ছিল সামগ্রিক জনযুদ্ধ, সব শ্রেণি পেশার মানুষের যুদ্ধ যার সূত্রপাত ১৯৫২। ইতিহাসের পরিক্রমায় এই আন্দোলন সংগ্রামে কেউ নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন না। এক অনিবার্য রক্তস্নানে সকলেই যুথবদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশের শিল্পী সমাজ অতুলনীয় নিষ্ঠার সাথে সময়ের দাবী পূরণ করেছিল, জাগিয়ে তুলেছিল মানুষের চেতনাবোধ। বিশ্ববিশ্রুত লেখক মিলান কুন্ডেরার মতে ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম’। আত্মদানের প্রতিজ্ঞায় দীপ্ত দীর্ঘ ধারাবাহিক অভিযাত্রা ছিল আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সাতচল্লিশের পর এদেশের মানুষ বুঝতে পারে যে স্বাধীনতা তারা পেয়েছে তা হচ্ছে ‘তথাকথিত শৃঙ্খলিত স্বাধীনতা’।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চারুশিল্পীরা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ঢাকা আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দিন। কিন্তু সেদিন তারা প্রদর্শনী বন্ধ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ।একুশের পোস্টার, ফ্যাস্টুন এঁকে আন্দোলনে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন শিল্পীরা। ১৯৬৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি হতে শিল্পীরা রাজপথসহ বিভিন্ন স্থানে আলপনা আঁকার রীতি প্রবর্তন করেন। শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে আঁকা আল্পনা বাঙালি সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে, সৃষ্টি করে নবচেতনার। ১৯৬৭ থেকে শিল্পীরা বিভিন্ন বার্তা বহনকারী ব্যানারের প্রদর্শনী করে এসেছিল। ১৯৬৯ বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে। সেই বছর ২১ ফেব্রুয়ারির স্লোগান ছিল ‘আজ পলাশ ফোটার দিন’। ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্ররা ‘অ’ ‘আ’ অক্ষর দিয়ে ফুলের বলয় এবং আন্দোলনের বার্তা বহনকারী স্বরবর্ণের ব্যানার শহীদ মিনারে টাঙায়। এই কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী, মুস্তাফা মনোয়ার, শাহাদাৎ চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডল, আবুল বারক আলভী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আনোয়ার হোসেন, লুতফর রহমান, ইমদাদ হোসেন প্রমুখ। ১১ দয়া আন্দোলনে চারুশিল্পীদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে প্রথম সভা হয় তৎকালীন ইকবাল হলে। এই সভায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ। সিদ্ধান্ত হয় আন্দোলনের জন্য শিল্পীরা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি করবে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন ডাকসুর সেই সময়কার সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর। আর্ট কলেজে প্রতিদিন রাত জেগে পোস্টার লেখা হতো। প্রতিদিন এক রিম কাগজে সর্বোচ্চ ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই কাজে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, মঞ্জুরুল হাই, শহীদ কবির, রেজাউল করিম, বিজয় সেন, অলক রায়, স্বপন চৌধুরী, হাসি চক্রবর্তী, মনসুরুল করিম সহ আর্ট কলেজের ছাত্ররা এই কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কর্মসূচি ছিল ১১ দফার পর। ২০ জানুয়ারি পুনরায় সভা হয়। সেইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। ২৪ জানুয়ারি শহিদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউট এর নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। রচিত হয় বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। মিছিলের স্লোগান ও চারুশিল্পীদের আঁকা ব্যানার পোস্টারে মানুষের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের বাঁচার দাবি ৬ দফা ঘোষণার কিছুদিন পর গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯ এ সারা দেশ জনরোষে ফুসছিল। ১৯৬৯ এর ২১ ফেব্রুয়ারী শহিদ মিনার চত্বরে দশ বারো ফুট আকারের ক্যানভাস জুড়ে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। যেখানে ফুটে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈরশাষকের নিপীড়ন শোষণ ও বঞ্চনার কথা, বাঙালির অধিকারের কথা। ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী সহ অনেকে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্পীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যানার, ফেস্টুন অঙ্কন করেন। ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’ নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘আবহমান বাংলা, বাঙালি’ শীর্ষক ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। শিল্পী সবিহ উল আলম, এনায়েত হোসেন, আবুল মনসুর শওকত হায়দার, চন্দ্রশেখর দে, তাজুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম এই ম্যুরাল করেন। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে সভা সমাবেশ করেন ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন রঙ ও তুলিতে।
১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনে ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ’ এর ব্যানারে শিল্পীরা সভা সমাবেশ করেন। নেতৃত্ব দেন শিল্পী কামরুল হাসান, হাশেম খান, শাহাদাৎ চৌধুরী, বিজয় সেন, গোলাম সরোয়ার, মঞ্জুরুল হাই সহ অনেকেই।
দেশের শিল্পী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রঙ তুলি মারণাস্ত্রের চেয়েও কোনো কোনো সময় বেশি কাজ করেছিল। তাছাড়া অনেক শিল্পী রঙ তুলি রেখে অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীন এর নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। একাত্তরের এপ্রিলে খালেদ মোশাররফ এর অধীনে দুই নম্বর সেক্টরে তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আতংক ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি শাহবাগ রেডিও স্টেশনে ঢুকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। আরো যেসব শিল্পী মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন তাঁরা হলেন শাহাদাত চৌধুরী (বিচিত্রা সম্পাদক), জি এম এ রাজ্জাক, হরিহর সরকার, মইনুল হোসেন, সৈয়দ সালাউদ্দিন চৌধুরী, এম এ খালেক, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, জি এম খলিলুর রহমান, স্বপন আচার্য, ইয়াকুব খান, মজিবুর রহমান সিরজুদ্দিন, বনিজুল হক সহ অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে শিল্পী কামরুল হাসানের রং তুলির মারণাস্ত্র ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ ইয়াহিয়া খানের ভংয়কর চেহারার পোস্টারটি ইতিহাসের সাহসী স্বাক্ষী। ২র্০র্ ী ৩র্০র্ সাইজে সাদা কাগজে মুদ্রিত পোস্টারটি মুজিবনগর থেকে ডিপ্লোমেটিক ব্যাগের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রেরণ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশবিদেশে এই পোস্টারটি মারণাস্ত্র হিসেবে শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীদের করা আরো পোস্টারগুলোর মধ্যে ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’ ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো’ উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার তুলেধরে চিন্তামণি কর ও কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কোলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির সহায়তায় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বিড়লা একাডেমিতে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত ভাস্কর শ্রী দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ ধারাবাহিক গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক। এদেশের শিল্পী সমাজ সেই ধারাবাহিক আন্দোলন ও ইতিহাসের অন্যতম ভূমিকা পালনকারী। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটে, সংগ্রামে তাঁদের অবদান জাতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজীবন স্মরণ করবে। লেখক : শিশুসাহিত্যিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধমিয়ানমারের নববর্ষের পানি খেলায় স্বাগতম- এপ্রিল ২০১৭