মিয়ানমারের নববর্ষের পানি খেলায় স্বাগতম- এপ্রিল ২০১৭

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

হ রূপা দত্ত | শনিবার , ৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

সকাল ৬ টার মধ্যে বাগান রেলওয়ে স্টেশানে থাকতে হবে যদি টিকেট পেতে চাই। বাগান শহর থেকে ট্রেন স্টেশানে যেতে লাগে প্রায় ২০ মিনিট। আগের দিন পোপা মাউন্টেন থেকে ফেরার পথে স্টেশানে গিয়েছিলাম ট্রেনের টিকিটের জন্য। নববর্ষ উপলক্ষ্যে সব বাস চলাচল বন্ধ, ট্রেনই একমাত্র ভরসা। কিন্তু, ট্রেন চলাচলও বন্ধ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বলল তারপরেও স্টেশানে গিয়ে একবার দেখতে, কারণ এমন উৎসবের সময় অনেক সময় স্পেশাল ট্রেন সার্ভিস থাকে। স্টেশানে গিয়ে জেনেছি সকালে একটা ট্রেন মান্দালে শহরে যেতে পারে, কিন্তু নিশ্চিত না। সেই ট্রেন আসবে আবার আরেক জায়গা থেকে এবং অগ্রিম টিকেট বিক্রি হবে না। তাই সকাল সকাল স্টেশানে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। ট্রেন পাবো কি পাবো না, মান্দালে যাওয়া হবে কি হবে না, এতসব অনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা ভোররাতে বাগান শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সব গুছিয়ে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে জুতা পরতে গিয়ে আবিষ্কার হল, মিকার এক পাটি জুতা পাওয়া যাচ্ছে না। আরেক পাটি জুতা যেভাবে রাখা আছে, দেখে মনে হল কেউ জাস্ট একটা তুলে নিয়ে গেছে। আমরা ভাবলাম হয়ত কোন কুকুরের কাজ হতে পারে। কিন্তু, কুকুর নিলে তো অন্য পাটি জুতা এলোমেলো থাকার কথা। শুরু হল খোঁজ। আশেপাশে খুঁজে কিছুই পাওয়া গেল না। গাড়ির ড্রাইভার তাড়া দিতে লাগলো দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। শেষ পর্যন্ত হয়ত ট্রেন থাকলেও, আমরা আর ধরতে পারব না। হোস্টেলের কর্মচারীও ঘুম থেকে উঠে জুতা খোঁজা অভিযানে যোগ দিল। মিকা বলতে লাগল, শুধুমাত্র ভ্রমণ করার জন্যও অনেকদিন টাকা জমিয়ে ডিক্যাথলনের এই জুতা জোড়া কিনেছে অনেক দাম দিয়ে। আমার প্রবল সন্দেহ, এটা অবশ্যই কোন মানুষের শয়তানি হবে। হয়ত এক পাটি সরিয়ে রেখেছে, যাতে আমরা আরেক পাটি জুতা ফেলে যাই। আর সকালের তাড়াহুড়াতে আমরা খুব একটা খুঁজবও না। মিকা সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। মিকাকে আমার বাড়তি স্যান্ডেল জোড়া পরতে বললাম। আমি যখন হোস্টেলের কর্মচারীর উপর মেজাজ দেখাচ্ছি, মিকা তখন জুতা খোঁজার সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নিল। ওর ভাষ্যমতে, হারিয়ে যখন গিয়েছে কি আর করা! জুতাতো গেছেই, এবার ট্রেনটা যাতে মিস না করি। সঠিক কথা, কিন্তু আমার মেজাজ ততক্ষণে খারাপ হয়ে গেছে। আর ঠিক সেইসময় আমাদের গাড়ির ড্রাইভার মিকার হারিয়ে যাওয়া জুতা নিয়ে হাজির। সে নাকি রাস্তার ওপারে ঝোঁপের কাছে পেয়েছে। রাস্তার ওপারে এই জুতা যাবে কীভাবে, কিংবা ড্রাইভারও সেই ঝোঁপেই কেন খুঁজতে যাবে এই সব অমীমাংসিত প্রশ্নকে পেছনে ফেলে নাটকীয় আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম স্টেশানের উদ্দেশ্যে। এক সূর্যোদয়ের সকালে আমরা বাগান শহরে এসেছিলাম, আরেক সূর্যোদয়ের সকালে আমরা বাগান শহর ছেড়ে যাচ্ছি।
স্টেশানে গিয়ে টিকেট কাউন্টারে দৌড় লাগালাম। ট্রেন আসবে কি? কাউন্টারের মানুষ জানালো – ইয়েস, একটা ট্রেন আসবে। টিকেট কাটতে পেরে আমাদের মত আনন্দিত আর কেউ হয়েছিল কিনা সেদিন সকালে, এতে সন্দেহ আছে। রেলওয়ে স্টেশনটা দারুন সুন্দর। ঢুকতেই কারুকার্যখচিত হালকা সাদা- গোলাপির গেইট। দেখতে অনেকটা পোড়ামাটির কাজ মনে হয়। ট্রেন আসতে সময় লাগবে। আমরা দূরে গিয়ে বসলাম। আস্তে আস্তে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি আট ঘন্টার ট্রেন জার্নির জন্য।
কলকল করতে করতে আমাদের সিট খুঁজে নিয়ে বসলাম। মিয়ানমারের এই ট্রেন, বাংলাদেশের ট্রেনের মত। দেখে মনে হয় সেই ব্রিটিশ আমলের জিনিস। থিতু হয়ে বসতেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। ট্রেনে কর্মরত ব্যক্তিরা এসে বলে গেল জানালা যাতে বন্ধ করে রাখা হয়। এমন সুন্দর সকালে জানালা কেন বন্ধ রাখতে হবে, এই আহাম্মকিতে আমরা মোটেই কান দিলাম না। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে এল ট্রেন ছেড়েছে। আস্তেধীরে হেলেদুলে ট্রেন চলছে। আমাদের চোখও বুজে এল। হঠাৎ ঝপাৎ করে বাইরে থেকে ছুড়ে মারা পানি এসে আমাদের একেবারে কাকস্নান করিয়ে দিল। তন্দ্রালু চোখে তাড়াহুড়ো করে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম রেল লাইনের ধারে গ্রামের ছেলেবুড়ো বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর যেই কোন খোলা জানালা দেখছে সেখানে পানি ছুড়ে মারছে। আমি আর মিকা পরস্পরের দিকে হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। কি ঘটে গেল সেটা অনুধাবনের চেষ্টা করছি, হঠাৎ দু’জনই জোরে হেসে উঠলাম- ‘ওয়েলকাম টু দি ক্রেজি ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল ইন মিয়ানমার’।
মিয়ানমারে নববর্ষকে বলে থিংয়্যান। হিন্দু পুরাণ থেকেই এই উৎসবের সূত্রপাত হয়। প্রচলিত গল্প হল, ব্রহ্মা ইন্দ্রের কাছে একবার বাজিতে হেরে গিয়েছিল। তখন বাজির শর্ত অনুসারে ইন্দ্র ব্রহ্মাকে আটকে রাখে একটি হাতির মাথা কেটে ব্রহ্মার মাথায় বসিয়ে দেয়। ব্রহ্মার এই রূপ আমাদের কাছে দেবতা গনেশ বলে পরিচিত। এইদিকে ব্রহ্মার মাথা নিয়ে পড়া গেল ভীষণ মুশকিলে। এই কর্তিত মস্তক সাগরে ফেললে সাগরের সব জল শুকিয়ে যায়, মাটিতে ফেললে মাটি আগুনের মত গরম হয়ে যায় আবার আকাশে ছুড়ে মারলে বাতাসে আগুনের শিখা জ্বলে উঠে। শেষপর্যন্ত দেবরাজ ইন্দ্র বিধান দিলেন যে, ব্রহ্মার মাথা কোথাও ফেলা হবে না। প্রতি বছর এক এক রাজকুমারির কাছে থাকবে এই দেহহীন মাথা। এক বছর পর পর এই মাথা এক রাজকুমারি আরেক রাজকুমারিকে হস্তান্তর করে। আর এই হস্তান্তরের সময় যে উৎসব হয় সেটাই হল মিয়ানমারের থিংয়্যান উৎসব, যেটি নববর্ষের উৎসব হিসেবে পরিচিত। মূলত বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার অনুসারে এই উৎসবের দিন ঠিক করা হয়। সাধারণত এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত এই উৎসব চলে। একই সময়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলতেও নববর্ষ পালিত হয়। সূত্রভেদে খ্রিষ্টের জন্মের ৪৪৫ অথবা ৪৪৩ বছর আগে বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার শুরু হয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় দেশগুলোতে এই সময়ে হয় পানিখেলা। বাংলাদেশে এবং থাইল্যান্ডেও আমি পানিখেলা দেখেছি, কিন্তু মিয়ানমারের পানিখেলা একেবারে অন্য লেভেলের। এখানকার মানুষের কাছে এই পানি খেলা হল পুরাতন বছরের সকল খারাপ এনার্জিকে ধুয়ে ফেলে নতুনভাবে শুরু করার মাধ্যম। থাইল্যান্ডের পানিখেলাও দারুণ জমে, তবে ঠিক এখানকার মত এত অকৃত্রিম মনে হয়নি।
আমাদের সামনের সিটে বসেছেন এক নারী। উনি খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। কথায় কথায় জানা গেল, ওনার নাম ওয়েত ইন তিন এবং তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। ছুটিতে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন, এখন নিজের বাড়ি ফিরছেন। এই সময়টায় স্কুলে লম্বা ছুটি দেয়, আর সময়টাকে কাজে লাগিয়ে একটু বোনকে দেখে এলেন। চল্লিশোর্ধ এই নারী অবিবাহিত, থাকেন তার মায়ের সাথে। ওয়েত ইন তিন এর সাথে আমাদের গল্প জমে গেল। উনিও ঘুরতে খুব ভালবাসেন, কিন্তু দেশের বাইরে কখনও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আবার ঘরে বৃদ্ধ মাকে ফেলে খুব একটা ঘুরতে যেতেও পারেন না। আমাদের খুব ধরলেন ওনার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য। ওনার বাড়ি যদি মান্দালে শহরে হত, তাহলে আমরা হয়ত গিয়ে উঠতাম। কিন্তু, উনার বাড়ি মাঝামাঝি এক জায়গায়। আমাদের সময়ের টানাটানিতে ওনার নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হল। আবার মনে অবশ্য আরেকটা ভয়ও ছিল, মিয়ানমারে বিদেশীদের বাণিজ্যিক আবাসন মানে হোটেল, হোস্টেল এসব ছাড়া আর কোথাও থাকার অনুমতি নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করার সময় জেনেছিলাম, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে কেউ সরকারি অনুমতিপত্র না নিয়ে বেড়াতে গেলে, যদি শত্রুতা করে কেউ পুলিশকে জানিয়ে দেয়, তাহলে জরিমানা দিতে হয় এবং জেলও খাটতে হয়। যদিও রোহিঙ্গাদের বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা, তারপরেও সব ধরনের ঝামেলা এড়াতে নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেই হল। তবে, ওয়েত ইন তিনকে রোহিঙ্গা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানলাম, এ বিষয়ে উনি কিছু জানেন না। কেবল জানেন, রাখাইন অঞ্চলে মুসলিমদের সাথে রাখাইনদের গন্ডগোল আছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়েও খুব একটা কিছু উনি জানেন না। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আমাদের সমতলের মানুষের যেমন পরিষ্কার কোন ধারণা বা আগ্রহ নেই, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটাও ওনার কাছে তেমন মনে হল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি হাজার হাজার সেগুন গাছের লগ সারিসারি স্তূপ করে রাখা, কেবল কাঠ চেরাই মেশিনে দিয়ে সাইজমত কাটাই বাকি। ওয়েত ইন তিন জানালো বেশিরভাগ সেগুন গাছ বাণিজ্যিক চাষের, তবে এর মাঝে বন থেকে চুরি করে কেটে আনা গাছও ঢুকে যায়। আমাদের দেশে বার্মাইয়া সেগুনকাঠের খুব কদর। এত এত গাছের লগ একসাথে দেখে বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। আমাদের সৌখিনতার জন্যই এইসব গাছেদের উজার করি, আমরা- মানুষেরা। কথা বলার মাঝে ওয়েত ইন তিন ওনার পাশের জানালাটা একটু খুলে দিল। কিছু সময় পর সামনে একটা স্টেশান দেখা গেল। ট্রেনের গতি ধীর হল এবং আবারও ঝপাৎ করে পানি এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। এবার আমাদের জানালা দিয়ে নয়, ওয়েত ইন তিনের খুলে রাখা জানালা দিয়ে। আমাদের আশেপাশের কিছু মানুষ একটু নাখোশ হল, কেননা পানি ওদেরও ভিজিয়ে দিয়েছে। ওয়েত ইন তিনকে অনুরোধ করে জানালা বন্ধ করালাম। স্টেশানের উপর পানির বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। আট-দশ বছরের এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর বয়স্ক এক লোকের সাথে। হয়ত ছেলেকে নিয়ে বাবা বের হয়েছে পানি ছুড়ে মারার আনন্দ করতে। কয়েকজন মধ্যবয়স্ক নারীকেও দেখলাম পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ট্রেন স্টেশান ছেড়ে এগিয়ে গেল। এই সক্কাল বেলা দুইবার পানিতে ভিজে খুব একটা আরাম লাগছিল না, তবে কপাল ভাল বাইরে সূর্যের তেজ কিছুটা বেড়েছে বলে মানিয়ে নেয়া গেছে। আমি আর মিকা কাপড় পাল্টে এলাম।
ওয়েত ইন তিন এর কাছে তার একা থাকার গল্প শুনতে চাইলাম। জানালো অনেক বছর আগে তার প্রাক্তন প্রেমিকের পরিবার তাকে মেনে নেয়নি, তারপর সেই প্রেমিকও তার পরিবারকে বোঝাবার খুব একটা চেষ্টা না করে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। এরপর বিয়ের উপর মন উঠে গেছে তার। একা থাকার সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে চাইলাম। উত্তরে যা বলল, তাতে বুঝলাম বিয়ে না করে থাকা মেয়েদের জীবন কম-বেশি সব জায়গাতে একই। ওয়েত ইন তিনকে সমাজের নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে, যার ফলে উনি শিক্ষকতার জগতের বাইরে তার মাকে নিয়ে নিজের ছোট জগত করেছেন, আর অবসরে ছবি আঁকেন। আমার ডাইরিটা চেয়ে নিয়ে আমাকে বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব আঁকতে শেখাতে শুরু করলেন। প্রথমে শেখালেন কুকুর আঁকা, তারপর ইঁদুর, হরিণ। ট্রেন ছুটে চলেছে অনেকটা বিরাণভূমির মাঝ দিয়ে। দারুণ শুষ্ক অঞ্চল। ছোট ছোট ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছু নেই মাইলের পর মাইল। প্রায় তিন-চার ঘন্টা ট্রেন চলেছে। আমার চোখ আবার বুজে এল এবং আবার পানিতে ভিজে ঘুম ভাঙল। এবারও পানি এসেছে ওয়েত ইন তিন এর জানলা দিয়ে। একটু বিরক্ত হলাম। ওনার নাকি গরম লাগছিল, তাই অল্প করে জানালা খুলে রেখেছে। ভেজা কাপড় নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙ্গে বাইরে তাকিয়ে দেখি হাজার হাজার তাল গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’, রবি ঠাকুরের ছড়ার মত লম্বা লম্বা গাছগুলো যেন আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে আছে। এর পর মাইলের পর মাইল কেবল এই তাল গাছ দেখলাম। ওয়েত ইন তিন কয়েকবার জানালা খুলতে গেল আর আমরা সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠলাম, ‘বন্ধ করো, বন্ধ করো’। আমার আর মিকার চোখ আটকে গেল ওয়েত ইন তিন-এর জানালার দিকে, কখন আবার ও জানালা খুলে দেয়। আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম, তখনও একবার অল্প করে ভিজেছিলাম। চারবার ভেজার পর পানিখেলা আমাদের কাছে আতঙ্কের সমার্থক হয়ে দাঁড়াল। যদিও ওয়েত ইন তিন সেটা খুব একটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। ওদের কাছে হয়ত উৎসবের দিনে এইটাই স্বাভাবিক। ও আমাদের বিস্কিটের মত একধরনের খাবার খেতে দিল। দেখতে দেখতে ওয়েত ইন তিন এর নামার সময় হয়ে এলো। বাকি রাস্তায় আমি আর মিকা। জানালার বাইরে এখন পাহাড়ি এলাকা। এই কয় ঘন্টার ট্রেন জার্নিতে বেশ কয়েক রকমের বৈচিত্রপূর্ণ প্রাকৃতিক অঞ্চল দেখলাম। দুপুর ৩ টা নাগাদ ট্রেন মান্দালে শহরে এসে পৌঁছালো। আমি মান্দালে থেকে আমার আর মিকার পথ আলাদা হয়ে যাবে। মিকা আরও কিছুদিন ঘুরবে, কিন্তু আমাকে অফিস ধরার জন্য ছুটতে হবে। ট্রেন থেকে নেমে আমি আগে ইয়াঙ্‌গুনের টিকেট করতে গেলাম। থার্ডক্লাস ছাড়া আর কোন টিকেট নেই। ‘উপায় নাই গোলাম হোসেন’ ভাবতে ভাবতে পরের দিন রাতের টিকেট কেটে নিলাম। স্টেশনের বাইরে এসে যখন হোস্টেলে যাওয়ার ট্যাঙি খুঁজছি, দুইজন বিশ-বাইশ বছর বয়সী পশ্চিমা ভ্রমণকারী এগিয়ে এসে জানতে চাইল আমরা কোথায় যাচ্ছি। ওরা ঘুরতে যাবে মান্দালের বিখ্যাত সেগুন কাঠের ব্রিজ দেখতে। এটি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা সেগুন কাঠের ব্রিজ। কিন্তু, শহর থেকে একটু দূরে হওয়াতে এবং থিংয়্যানের কারণে ট্যাঙির দাম একটু বেশি, তাই ওরা আরও মানুষ খুঁজছে খরচ কমনোর জন্য। মান্দালে আসার আগে এই ব্রিজ দেখতে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। আমি আর মিকা দুইজনেই ভাবলাম, খারাপ কি! যাই দেখে আসি পৃথিবীর দীর্ঘতম সেগুন কাঠের ব্রিজ। কি আর আছে জীবনে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সমাজ
পরবর্তী নিবন্ধপুরুষ লেখকের কলমে নারী-চরিত্র