মুক্তিযুদ্ধের সমুজ্জ্বল বীরত্বের গাথা

কথাশিল্পী নাসের রহমানের ‘শহীদের রক্তে রাঙানো’

অরুন সেন | শুক্রবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

অনুগল্পের লেখকেরা নিজস্ব দর্শনবোধে আর অব্যক্ত ব্যঞ্জনার শিহরণে সিক্ত করে গল্পকে নান্দনিক ঢঙে উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন। তেমনি নানারকম গল্পকে ভাষার ছন্দোবদ্ধ মলাটে আবদ্ধ করে পাঠকের প্রত্যাশার আল্পনায় কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া, চঞ্চল শিশুমনের অধরা ব্যঞ্জনার অনুরণন,পরিশীলিত জ্ঞানের ভান্ডারে পরিমাপহীন বাস্তব সম্ভাবনার উঁকিঝুকি,বিস্তৃত সাহিত্যের সুসংবদ্ধ কাঠামো বিন্যাসে রচিত অনবদ্য সাহিত্যকর্মের রচয়িতা হিসেবে পাঠককূলে পরিচিত একটি নাম নাসের রহমান। নাসের রহমানের এবারের ভাবনার বিষয়ে স্থান করে নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধেও নানান গল্পের সমাহার।

শুরুর গল্পের নাম ‘নদীর নাম নবগঙ্গা’। এই নবগঙ্গার তীরে সেদিন জন্মেছিল এক বীর শহীদ মুন্সি মুজিবর, সেই বীরের মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। যার কষ্টের কোনো সীমারেখা নাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে জেগে উঠা বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ে মিশে থাকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বাণীতে জন্ম হয়েছিল নবগঙ্গা নদীর প্রাণশক্তি। একজন শহীদ মুজিবরের স্বপ্নে আঁকা হয়েছিল প্রিয় স্বদেশের নাম। লেখকের মুন্সিয়ানা আর শিল্পবোধে মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য অসাধারণ গল্প হয়ে উঠল পাঠককূলে।একে একে সৃষ্টি হলো ‘শহীদের রক্তে রাঙানো’ আর ‘জীবন্ত কবর’ গল্পে। এই গল্পের মূল বিষয় মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের সময়কাল। এলাকায় এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়া আর দিনে দিনে তা দুর্বার ছাত্র-আন্দোলনে রূপ নেয়ার গল্প। রাজাকারদের পাকিপ্রেম আর পাকি-পতাকা পোড়ানোর গল্প এগিয়েছে সমানতালে। হাফিজ ডাক্তার আর তার ছেলে বেলাল সুজার আত্মত্যাগের সুমহান চেতনায় যেন মুক্তিযুদ্ধের কান্না নিঃশব্দতার এক লেলিহান শিখা।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরেও বাঙালির জীবনে আশার আলো জ্বলে নাই, সেই গল্প রচিত হয়েছে ‘বীরের রক্তস্রোত’ গল্পে। লেখক এখানে সযতনে চিত্রিত করেছেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সেলিমুজ্জামানের কথা। এক কিশোর তার স্বপনে দেখেছে বাংলাদেশ, কিন্তু সেই কিশোর ছেলেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেশকে স্বাধীন করেছে সে, এই আত্মত্যাগ হলো আজকের বাংলাদেশ। গল্পের স্রোতে রাজাকারদের ঘৃণ্যতা আর পিশাচের ভূমিকা আমরা দেখি ‘সৈকতে বাবার লাশ’ গল্পে। একজন ইলিয়াছ মাস্টার পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বাবা। সন্তান হারানো সেই বাবার গল্প লেখক বিধৃত করেছেন নিজের মতন করে।

কিন্তু এ গল্পে তৎকালীন হিংস্র রাজাকারদের কথা ফুটে উঠেছে। এক সাগর দুঃখকষ্ট নিয়ে বাবার সন্তান অপেক্ষায় আছে, কিন্তু কালের গর্ভে বাবা চলে গেছে, সন্তানের জন্য রেখে গেছে এক নতুন দিন। ‘সলিল সমাধি’ গল্পে লেখক পাকিস্তান-আমলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ওপর নানারকম বিধি-নিষেধের বিষয়টি তুলে এনেছেন। বাঙালির প্রাণের পহেলা বৈশাখ আর শোভাযাত্রা না করার জন্য নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সামরিক সরকার। কিন্তু এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন এমলাক হোসেন। ৭০-এর নির্বাচনে এমলাক নৌকা-প্রার্থীর প্রচারণায় নামেন। ৬ দফার দাবিতে সোচ্চার এমলাকের বাড়িঘর লুট হয়। মেহেরপুরের কাজলা নদীর স্রোতে লাশ ভেসে গিয়েছিল। রক্তনদীর সমাধিতে সলিল সমাধি হলো এমলাকের, যার বিনিময়ে প্রিয় স্বদেশের জন্ম হলো। যুদ্ধের গল্প ‘স্বপ্নের আর্তনাদ’।

১৯৭১এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পটভূমিতে লেখা এই গল্পে ঘাতক পাকিস্তানী বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টাপাল্টি আক্রমণে ধরাশায়ী হানাদারবাহিনীর মরণকামড়ে আতিয়ারের মতন লক্ষ লক্ষ তরুণ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আতিয়ার ছিলেন স্বপ্নবাজ। সেই স্বপ্নকে বেয়নেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার। সেই হত্যায় রক্তের খেলা হয়েছিল। কিন্তু পারেনি হানাদার পাকিস্তানি।

একইভাবে আমরা দেখি র্মিজা মাহতাব বেগ, যিনি নিজের তিন সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে এসেছেন, শুধু পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। বীরের মতন লড়াই করে প্রিয় স্বদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। বাঙালির মনে চিরজাগরুক মাহতাব বেগ, প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিবে আলোকশিখা। লেখকের এই গল্পের নির্যাসে বীর বাঙালির মুক্তিকামী মানসচিত্র ফুটে উঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রথম শহীদের গল্প লেখক এনেছেন ‘পদ্মার ঢেউ’ গল্পে। নদীর কলতানে সে পেয়েছিল মুক্তির স্বপ্ন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে পদ্মার ঢেউয়ের মতো মহানন্দার কলতানে কাটানো শৈশব। অবিরাম উদারতার গান শুনেছেন তিনি পদ্মার পাড়ে। নাসের রহমান নিজস্ব ঢঙে রচনা করেছেন সেই বীরের গল্প। পতাকার মানচিত্রে আমরা খুঁজে পাই চিরচেনা ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ২৫ মার্চ কালরাতের গল্প।

২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সারাদেশে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের দিন সৈয়দপুরের চিকিৎসক আজিজ সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ওড়ান। শেষে বাঙালিবিদ্বেষী বিহারীদের হাতে প্রাণ হারানো আজিজ সরকার চিরঅমলিন, কেননা স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন তারা দেখেছেন আপন আঙ্গিকে।
নাসের রহমান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক সময়কালের একেকটি গল্প রচনা করেছেন নিজস্ব লেখনীর ছোঁয়ায়। ‘শোকবিহ্বল’, ‘প্রেমসমাধি’ গল্পে লেখক চিত্র এঁকেছেন সেই সময়ের। মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালির প্রিয় স্বদেশের পতাকা বর্ণিল আকাশে ওড়ানোর মানসে। নাসের রহমানের নিজস্ব ছন্দে গল্পগুলো যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের দিনগুলোতে।

মুক্তিযুদ্ধেও প্রামাণ্য দলিল আর সেই চিরঞ্জীব বীর সেনানী অদম্য বাঙালিদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আর আত্মত্যাগের গল্প রচনায় নাসের রহমান স্মরণ করেছেন তাদের বীরগাথা। অর্জিত স্বাধীনতার মুক্তির বাতাসে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর। কালোত্তীর্ণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত গল্পগ্রন্থ ‘শহীদের রক্তে রাঙানো’ বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে কথাসাহিত্যিক নাসের রহমানের এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন। মুক্তিযুদ্ধের স্বতন্ত্রধারার ১২টি গল্প নিয়ে ‘শহীদের রক্তে রাঙানো’ যার প্রথম প্রকাশনাকাল ফেব্রুয়ারি ২০২২। আগামী প্রকাশনীর তিনশত পঞ্চাশ টাকা মূল্যের বইটির প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈত্য প্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধআগুনে পুড়ল ৩ দোকান