মা-প্রকৃতির সেবায় একজন বিজ্ঞানী

রিতু পারভী | শনিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ

তেল লাইনে ফাটল এবং ছড়িয়ে পড়া তেল নাইজার ব-দ্বীপকে পরিবেশ বিপর্যয়ের এক ভয়াবহ স্থানে পরিণত করে। যুদ্ধবাজ বিদ্রোহীদের প্রায়শই তেলের পাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়া, উদাসীন তেল কোম্পানি, কিডন্যাপিং, বহিরাগতদের প্রতি অবিশ্বাস নাইজার ব-দ্বীপের সার্বিক পরিস্থিতিকে করে তুলে ভীষণ নাজুক।
এমনই এক তেল চুপচুপে জায়গা যা আবার আগুনে পুড়ে বিধ্বস্ত তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ইউচারিয়া নাইচি নামে এক নারী। এই বিজ্ঞানী তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, স্থির, অবিচল লক্ষ্য নিয়ে এই ভুমি বাঁচাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
‘আমরা এমন সমাধান চাই যা সবুজ এবং প্রকৃতি-বান্ধব। প্রকৃতির কোন ক্ষতি না করেই আমরা এর সমাধান চাই।’ দৃঢ়ভাবে বিবিসিকে বলেন নাইচি।
চুয়াল্লিশ বছর বয়সী ইউচারিয়া নাইচি ‘জন ম্যাডক্স’ পুরস্কারে ভূষিত হন একজন বৈজ্ঞানিক হিসাবে যিনি সকল প্রতিকূলতার মুখে নিজের কাজের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। লন্ডনে পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে দীপ্ত এবং উল্লসিত কন্ঠে তিনি দর্শকদের বলেন, ‘একজন প্রথম আফ্রিকান নারী হিসেবে এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য আমাকে অভিনন্দিত করুন।’
পোর্ট হারকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-কেমিস্ট ইউচারিয়া তেল এবং অন্যান্য রাসায়নিক সিক্ত মাটি ও পানিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে খুব সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এটাকে বলে ‘প্রাকৃতিক নিরাময়’ পদ্ধতি যেখানে গাছ লাগিয়েই প্রাকৃতিক উপায়ে দূষণকারী উপাদান সরানোর ব্যবস্থা করা যায়। সেই জায়গা থেকে তেল বা রাসায়নিক অন্য জায়গায় সরানো কোন দরকারই পড়ে না।
যেসব জায়গার মাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে পারদ, লেড, ক্রোমিয়ামের মত ভারী ধাতু ছড়িয়ে পড়েছে সেসব জায়গায় পরিবেশ বিপর্যয় লক্ষ্য রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইউচারিয়াকে ডেকে পাঠানো হয়।
ইউচারিয়া গাছ লাগিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার কিছু কৌশল আবিষ্কার করেন। দূষণকারী উপাদানগুলো গাছের মাধ্যমে মাটি থেকে আলাদা করা হয়।
২০০৩ সাল থেকে ইউচারিয়া নাইজার ব-দ্বীপে কাজ করছেন। নাইজার ব-দ্বীপকে নাইজেরিয়ার বাগান বলা হয়, সেখানে রয়েছে গ্যাস এবং তেলের বিশাল সংগ্রহ।
পিএইচডি ছাত্র থাকাকালীন সময়েই তিনি দেখেন যে তেল শোধনাগার থেকে নির্গত বর্জ্য পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। এর ফলে সেই এলাকার মানুষের সাথে তেল কোম্পানিগুলোর একটা বিরোধ তৈরি হয়। ইউচারিয়া সমস্যার উৎস অনুসন্ধান করে পরীক্ষা প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে তেল কোম্পানিগুলোকে এই পরিস্থিতি পালটানোর জন্য রাজি করেন।
ভয়াবহ বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে বিজ্ঞানকে সঠিক কাজে লাগানোর এই উদ্যোগের জন্য ইউচারিয়া নাইচিকে ম্যাডক্স পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
চ্যারিটি সেন্স ইন সায়েন্স, যারা ম্যাডক্স পুরস্কার প্রদান করে, তার নির্বাহী ট্রেসি ব্রাউন ইউচারিয়া নাইচি প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিরুদ্ধ শক্তির বিপরীতে গিয়ে বিজ্ঞানকে যথোপযুক্তভাবে তুলে ধরে একটা কার্যকরী সমাধানে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ইউচারিয়া।’
এখানে ইউচারিয়ার যে জিনিসটা উল্লেখযোগ্য তা হলো তিনি স্থানীয় মানুষের মন জিতে নেয়া এবং তেল কোম্পানিগুলোকে ভূমি বিষমুক্তকরণে রাজি করানোর কূটনীতিতে জিতে যাওয়া।
কয়েক দশক ধরে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের প্রভাব জনগণের উপরে পড়লে স্থানীয় জনগণ আদালতের দারস্থ হতে বাধ্য হয়। ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডস এর আদালত তেল কোম্পানি ‘শেল’কে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে।
এর মধ্যে পরিবেশের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে তা’ নিয়ে সোচ্চার হন ইউচারিয়া। তেলের যে বর্জ্য তা সরানো বা পরিষ্কার করা এই সমস্যার সমাধান নয় মামলার সময় এ কথা তিনি বারবার বলেন। এর সমাধানে স্থানীয় মানুষকে পুরোপুরি যুক্ত হতে হবে, তাদের এটা অনুভব করতে হবে।
যেহেতু বিদ্রোহসংকুল এক জায়গা সেখানকার মানুষের সাথে যুক্ত হয়ে যেতে না পারলে কিডন্যাপড হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই ইউচারিয়া স্থানীয় নেতা, নারী নেতা, যুব নেতা সকলের সাথে যোগাযোগ করেন, তাদের বোঝান। সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, তাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করে তাদের সাথে মিশে যান নাইচি এবং বিশ্বাস অর্জন করেন।
বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে যুক্ত হয়ে সমস্যাগুলো যখন স্থানীয়রা নিজেরাই সমাধান করছিল তারা সবাই খুব উৎসাহী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদেরই বিজ্ঞানী ভাবছিল। এতে কাজ অনেক সহজ হয়ে আসে। গাছ লাগানোর ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতাও বিভিন্নভাবে কাজে লাগে। নাইচির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ক্ষতিগ্রস্ত জমিগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব, আবারও ফসল ফলানো, মাছ উৎপাদন সম্ভব।
আমেরিকার সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের প্রস্তাব ইউচারিয়া ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি নাইজার ব-দ্বীপেই কাজ করতে চান, দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে চান।
বিশ্বজুড়ে তেল-কোম্পানিগুলো পরিবেশবিদদের সন্দেহাতীতভাবে শত্রুর অবস্থানে। এমন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রেন্ডস অফ আর্থ এই নিয়ে বহু যুদ্ধ করেছে। স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়, পরিবেশগত বিপর্যয়, জীবন ব্যবস্থা পুরো ধ্বংস করার দায়ে তারা অভিযুক্ত। কিন্তু ইউচারিয়া এমন কোন পক্ষপাতে রাজি নন, তিনি কাজে বিশ্বাসী। জনগণকে দায়িত্ব নিতে হবে, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করাটা বেশি উপযুক্ত।
এতকিছুর পরেও বিভিন্ন সময়ে তিনি হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর যন্ত্রপাতি, তথ্য উপাত্ত ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তেল কোম্পানি থেকে তাঁকে সরাসরি হুমকি দেয়া হয় কিন্তু সব ধরনের হুমকির মুখেও তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি বলেন, ‘মা প্রকৃতি আমাকে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হওয়ার ডাক দিয়েছেন’ এবং তিনি সব কিছুতেই ভালো কিছুর শক্তি দেখতে পান। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের শক্তি মানুষকে সাহস যোগায়, ভরসা করতে শেখায়।
সূত্র : বিবিসি

পূর্ববর্তী নিবন্ধচুনতিতে গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটায় মামলা
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে ইয়াবা কারবারির যাবজ্জীবন