মানবতার ঈদ ও কল্যাণময় ঈদ

মেহের আফরোজ হাসিনা | শনিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

মেহেরুন নেছার কথা:

আকাশের ভালবাসার আনন্দের গতিধারায়

জেগেছে শাওয়ালের চাঁদ।”

ঈদের উৎসব যেভাবেই হোক একালের উৎসব আর সেকালের উৎসব ভিন্ন। সেকাল আর একালের সামাজিক কাঠামোতে অনেক পার্থক্য এসেছে। সেকালে থান কাপড় নিয়ে দর্জির দোকানে ড্রেস বানানো হতো, রেডিমেড জামা খুব একটা পাওয়া যেত না। একটি করেই জামা হতো আমাদের। আমরা দু’বোন পিঠাপিঠি হওয়াতে একই রকম জামাজুতা পেতাম। মাথায় লাল ফিতা দিয়ে মা দুটি ঝুঁটি বেঁধে দিতেন। আমাদের দু’বোনের সবকিছু একইরকম হতো, যেন আমরা দুই জমজ বোন। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত আমরা নতুন কাপড়জুতো সব লুকিয়ে রাখতাম, কেউ দেখলে পুরানো হয়ে যাবে তাই।

একালে হাতে মেহেদি দেওয়ার জন্য এখন আর মেহেদি গাছের তাজা পাতা নয়, এখন তো টিউবে করে রেমিমেড মেহেদি পাওয়া যায়। এখন সবাই পার্লারমুখী। ঈদের আগের রাতে পার্লারে ভীষণ ভিড় হয়। টিপ মেহেদি দিয়ে পার্লারে হাত ডিজাইন করে নেয়। রূপচর্চা আর মেহেদীর জন্য পার্লারে পার্লারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আগের দিনের মত তাজা গাছের পাতা এখন আর দরকার হয় না।

বর্তমানে ভালো লাগছে যে অন্তত ছোট কাপড় বর্জন করে পুনরায় লম্বা গাউন, কুর্তি, লেহেঙ্গা, লং কামিজ ফ্যাশনে ফিরে এসেছে।

যাই হোক বর্তমান ফ্যাশন ডিজাইনাররা শার্টপ্যান্টের ডিজাইনে নতুন প্রজন্মের জন্য সেই অতীতের ডিজাইনগুলো ফিরিয়ে এনেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনাররা লং ড্রেসের দিকে নজর দিয়ে গাউন, লং ড্রেস নিয়ে নানা রঙের বিভিন্ন পোশাক তৈরি করছেন, যা নজর কাড়ে সবার, নতুন প্রজন্মও সেই গাউন, লং পোশাক বেছে নিচ্ছে বেশি।

ডিজাইনাররা আগে যে সব জামাকাপড় তৈরি করে দেশের সংস্কৃতিকে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল, তারা বাংলার সংস্কৃতির কথা ভেবে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন দেখে ভালো লাগছে। ফ্যাশন ডিজাইনাররা বর্তমানের দেশীয় সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে ফ্যাশনে নতুন নতুন ধারা নিয়ে এসেছেন। বর্তমানের মেয়েরা গাউন, কুর্তি, লং স্কার্ট, স্কার্ট, লং কামিজ ড্রেস বেশি পছন্দ করছেন। হ্যান্ড পেইন্ট ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারিতে চমক দিয়েছেনএত নতুন কারুকাজদেখতেও ভালো লাগছে গাউনগুলোকে। আমরা চাই, পোশাকে ফিরে আসুক বাংলার সংস্কৃতি।

বয়স আমার বাড়ে না, তাই ঈদের ড্রেস নিয়ে আমি ভালোভাবে নজর দিই, দেশে কি নিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনাররা কাজ করছেন। ডিজাইনারদের পেছনে বিচ্ছুর মতো লেগে থাকি। হ্যান্ড পেইন্ট ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারির উপর প্রাধান্য দিয়ে সেকালের তাঁতের শাড়ি, মসলিন, জামদানি আবার নতুন করে এসেছে। তাঁতের কাপড়, এন্ডি, ধুপিয়ান এসব ফেব্রিকের উপরও লং বা লম্বা দৈর্ঘ্যের ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন এসেছে।

এখন আর চাঁদ দেখার জন্য মাঠেঘাটে ছুটে যায় না কেউ। কষ্ট করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না কেউ। সময়ইবা কোথায় এখনকার মানুষের। টেলিভিশনের সামনে বসে থাকে কখন ঈদের ঘোষণা করা হবে। ঘোষণা পেলে ঈদ হবে, নয়তো পরের দিন।

সেকালে হাতভর্তি করে মেহেদি দেওয়ার জন্য মেহেদি গাছের তাজা পাতা বেঁটে মেহেদি তৈরি করা হতো। মেয়েরা সেসব বাঁটা মেহেদি রাত জেগে হাতে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো, ভোরে উঠে হাত ধুয়ে সাজতে বসে যেত।

সেকালের নারীরা পায়জামা, কামিজ, ফ্রক ও শাড়ি পরত।

সেকালে ঈদের দিনে নারীরা পায়ে নূপুর পরত। একজন নারী এগিয়ে আসছে হাঁটার সময় সেটা নূপুরের আওয়াজের কারণে অনেক দূর থেকে শোনা যেত। মায়ের কাছে শুনেছি, তখন নারীরা সবসময় পায়ে নূপুর পরত, কোমরে বিছা পরত, হাতে বাজু পরত। এখনকার প্রজন্ম শুনলে বলবে এসব তো নাচের সাজ। আমি আমার বোনের মেয়েদের বলি, এসব নাচের সাজ নয়। আগের দিনের নারীদের সাজকে তোমরা এই যুগে নাচের সাজ মনে করছ।

সেকালে আকাশে এক টুকরো ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই খুশির খবর সবখানে পৌঁছে যেত। মোগল আমলে তো বন্দুক আর কামানের গর্জনে আওয়াজ তুলে বাংলার আকাশকে আনন্দে আনন্দে মুখরিত করা হতো।

রোজার শেষ দিন ঈদের চাঁদ দেখার জন্য বাবার হাত ধরে আমরা দু’বোন খোলা মাঠে দিয়ে হাজির হতাম। মাঠে বহু মানুষ আসতো। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম আকাশের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকতো। সরু সুতার মতো চাঁদ দেখা গেলেই সবাই পাড়ায় পাড়ায় আনন্দউল্লাসে মেতে উঠত। বড়রা লাইনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করতেন। মসজিদ থেকেই সাইরেন আর তোপধ্বনি বেজে উঠত। আমরাও বাবার হাত ধরে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম। মাকে জড়িয়ে ধরতাম খুশিতে। মাও খুশিতে মুখভরে খিলখিল হাসতেন। ঈদে ছোটদের জন্য সেলামি বরাদ্দ থাকত। ছোটরা নতুন কাপড় পড়ে সেকালে সেলামি পেত ১/২ টাকা। বর্তমানে সেই সেলামি হয়ে উঠেছে হাজার টাকার। রাত্রে বসে হিসাব করত কে কত পেল। এই সময়টার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করত। তখন ঘরে ঘরে রান্না হতো সেমাই, ফিরনি, পোলাউ, ভাত, মুরগি। আর একালে টেবিলজুড়ে থাকে মিষ্টিঝাল নানা পদের রান্না। সেকালে ঈদের দিন মেলা বসত। তিনদিন থাকত সে মেলা। মেলায় অনেক রকমের আয়োজন থাকত। চরকা ঘুরত, বায়স্কোপ থাকত, একটি বাক্সের মধ্যে ১ টাকার বিনিময়ে ছবি দেখানো হতো, তাও সময় ছিল বাঁধা। সবাই মেলায় ছুটে যেত। মেলায় ঢোল, বাঁশি সবাই থাকত। আমার বোনের মেয়েরা বলে, তুমি তো মোগল আমলের নারী, সব পুরনো কথা টেনে টেনে নিয়ে আসো, আমরা ড্রেস পরলে এটা হবে না, ওটা হবে না। তোমার পুরনো যুগের কথা শুনতে ভালো লাগে নাবলতে বলতে থম থম করে আমার পাশ থেকে চলে যায়।

আমি আসলে চাই যে অতীতের ঠিকানায় ফিরে যেতে। চাই যে সমাজ সচেতন হোক নিজের সংস্কৃতির প্রতি। মানুষে মানুষে সেই সহমর্মিতা ও ত্যাগের আদর্শ থেকে যেন আমরা দূরে সরে না যাই। বাংলার সংস্কৃতিই আমাদের ঠিকানা।

এসো এসো ছেলেমেয়েরা / আকাশে উঠেছে নতুন বারতা নিয়ে চাঁদ,/ চাঁদের আলোতে হাত পুড়ে যাবে না, /পূর্ণিমার

চাঁদ না থাকলে পৃথিবী আলোকিত হতো না/ অন্ধকারে কালো হয়ে যেত, এই চাঁদ/ সুকান্তের ঝলসানো রুটির মতন নয়পৃথিবীতে/ আলো দেয়ার জন্য এই চাঁদ ॥”

আমাদের ইসলাম ধর্মে ঈদ, আনন্দ, রোজা সব একসঙ্গে সম্পৃক্ত। রোজার শেষে আমাদের হযরত মুহাম্মদ (.) বলেছিলেন, আগামীকাল ঈদ, আনন্দ মিষ্টিমুখ উৎসবের দিন। আমি চাই, ফিরে আসুক সেই ঈদের আনন্দ।

লেখক : শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএলো ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধতুমি রবে নীরবে