তুমি রবে নীরবে

মর্জিনা আখতার | শনিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

সোমবারটা আমাদের কাছে ছিল অন্যরকম আনন্দময় ও প্রিয় একটি দিন। এই দিনে ‘সাম্প্রতিক’ চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’ এই শিরোনামে ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকার উপ সম্পাদকীয় পতায় সাখাওয়াত হোসেন মজনুর একটি কলাম বের হতো। তাই তিনি রোববার রাতেই সেল ফোনটা হাতের কাছে রাখতেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার অপেক্ষায় পায়চারি করতেন। পত্রিকাটা পাওয়ার সাথে সাথে হাতের কাছে মোবাইলটা নিয়ে পড়ার জন্য বসে যেতেন। পুরো পত্রিকা উল্টে পাল্টে পড়ে নিজের লেখাটাও একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন। সাথে সাথে অবিরাম ফোন আসতে থাকতো। পাঠকগণ প্রতিক্রিয়া জানাতেন তাঁর লেখায় উঠে আসতো মানুষের জীবন ধারার রোজ নামচা কেউ মুগ্ধ হয়ে ধন্যবাদ জানাতেন কেউ কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়তেন, আবার কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন তাদের জীবনের সাথে লেখার বিষয়বস্তু মিলে যেতো বলে। আবার কেউ কেউ স্বসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে কাছে ডেকে নিতো। কেউ কেউ কথা বলবার জন্য বা দেখবার জন্য বাসায় চলে আসতেন। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে তিনি অবিরাম কলাম লিখেছেন।

যখন থেকে কলাম লেখা শুরু করেছেন, তখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। তাই প্রচুর চিঠি আসতো সাদা, হলুদ, বাদামী ও নীল খামে। কতজনের সুখ দুঃখ মিশ্রিত কথা।

জীবন যন্ত্রণা এবং জয় পরাজয়ের কথা এই খামে বন্দী হয়ে আসতো। এভাবে কলাম লেখার মাধ্যমে একজন সাখাওয়াত হোসেন মজনু অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পাঠকের ভালবাসা মুগ্ধ কলামিস্ট হয়ে উঠেন। সহজ, সরল ভাষা ও আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে বিষয়বস্তুর সাবলীল উপস্থাপনাই ছিল মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়ার অন্যতম হাতিয়ার। আমি নিজেও অভিভূত হয়ে যেতাম, যখন অনেকগুলো ফোন আমার কাছেও আসতো। আমার পরিচিত অপরিচিত তাঁর লেখার ভক্তরা বলতো, তাঁরা প্রতি ‘সোমবারে অপেক্ষায় থাকেন কখন ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকাটি আসবে কখন লেখাটি পড়বেন। তখন উনার জীবনসঙ্গী হিসেবে এক অজানা আনন্দে আমারও মনটা ভরে উঠতো। এমনকি মুখোমুখি বা কাছাকাছি প্রতিবেশিরা কলামটি পড়ে একবার ফোন না করে থাকতে পারতেন না।

তাঁর এ পাঠকপ্রিয়তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি ছিলেন সকলের কলামিস্ট। তিনি ভালবাসতেন সব শ্রেণি পেশার সব বয়সের মানুষদের। তিনি যখন শিশু কিশোরদের জন্য লিখতেন , তখন তাঁর লেখায় ইতিবাচক দিক নির্দেশনা থাকতো। কীভাবে কিশোরদেরকে ভুল ভ্রান্তি থেকে সুরক্ষা করে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় তার পরামর্শ থাকতো। যখন তরুণদের জন্য লিখতেন তখন তাদের ভবিষ্যত জীবনকে কিভাবে সুন্দর করা যায় এবং কি করা উচিৎ, কি করা অনুচিৎ তা গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে লিখতেন।

বর্তমানে আমাদের সমাজে বয়স্ক মানুষগুলো অনেক অনাদর ও অবহেলায় থাকেন। সন্তান সন্ততি ও তরুণ প্রজন্মকে প্রবীণদের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য প্রেরণা দিতেন। সমাজের বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে এনে সকলকে প্রাণিত করতেন।

তাঁর লেখা বিদ্রোহ করতো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, সামাজিক অনাচার এসবের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন লড়াকু। তাঁর প্রস্তাবনায় অনেক বরেণ্য ও স্মরণীয় মনীষীদের নামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন চত্বর ও সড়কের নামকরণ করেছেন।

পথ চলতে চলতে তিনি লক্ষ্য করেছেন শুধুমাত্র আর্থিক কারণে কতো অমূল্য প্রতিভা ঝরে পড়ছে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুবিধা বঞ্চিতদের কথা ভেবেছেন এবং তাদের জন্য কাজ করেছেন, অনেকেই লেখাপড়া শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আবার সময়ের পরিক্রমায় কাজ করতে করতে তিনি একবার জানতে পারলেন মাবাবার কুমারী মেয়ের কারো ব্রেস্ট ক্যানসার, কারো জরায়ু ক্যান্সার মাবাবা বিব্রত বোধ করছেন। তিনি জানতে পেরে সেই মাবাবাদের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসায় সহযোগিতা করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন এবং বেঁচে থাকার মন্ত্র শিখিয়েছেন। কত দম্পতি ভাঙনের মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তাঁর কলাম পড়ে।

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি না হলে অন্যটি হতো না। তিনি কিশোর বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদান প্রদানে সাহায্য করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জয়পরাজয়, নানা রকম সাহসের গল্প, মুক্তিযোদ্ধাদের মানবেতর জীবন যাপন গল্প, পঙ্গুত্ববরণ ইত্যাদিও উঠে এসেছে তার কলামে। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে কষ্টের জায়গাগুলো আবিষ্কার করতেন ও সমাধানের চেষ্টা করতেন। চিকিৎসা শিক্ষা, অন্নবস্ত্র, বাসস্থান প্রতিটা ক্ষেত্রেই তিনি অসহায় মানুষের পাশে থেকেছেন।

তাঁর আকাশে মেঘ ছিল না। ছিল ঝলমলে এক সূর্য। সেই সূর্যের আলোতে সবাই ছিল উদ্ভাসিত। এখনো পাঠকেরা ‘সোমবার’ এলেই বলেন, “আমরা উনাকে অনেক মিস করি।” ‘সোমবার’ আমাকেও কাঁদায় এদিনে আমার ও আমার উত্তেজনা নেই, আনন্দ নেই, নেই অনুভূতি, আছে শুধু বিষাদের গীতি।

এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সব শেষ হয়ে গেল। মনে হয় এই তো সেদিনসব শেষ হওয়ার দু’দিন আগে ও দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক জনাব রাশেদ রউফের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। সোমবারের লেখাটা অসুস্থতার কারণে লিখতে পারছেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তখন রাশেদ রউফ ভাই বলেছিলেন চিন্তা করতে দেবেন না আগে সুস্থতা তারপর লেখা। কিন্তুু না, তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। সকল ভালবাসার মানুষ, ভাইবোন, আত্মীয় পরিজন, ভক্ত পাঠককে ফেলে, আমাকে একা করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এই কলামের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সাথে সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর মজবুত এক বিনি সূতোর বাঁধন। সেই বন্ধন ছিন্ন করে ২০২১ সালের ১ মে করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি অকালে বড় অসময়ে বিদায় নিলেন। তাঁর মৃত্যুতে হয়ে গেল এই জগতের অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা হারালাম তীক্ষ্ণ মেধাবী, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও পরিশ্রমী একজন গবেষক ও কলাম লেখককে। এই ক্ষুরধার লেখক সবসময় সমকালীন পরিবেশপরিস্থিতি, বিরাজমান সমস্যা, করোনা মহামারী ও নিত্য নতুন সময়োপযোগী বিষয়ে নিয়মিত লেখা উপহার দিয়ে পাঠকমন জয় করেছিলেন।

বড় অবেলায় থেমে গেল জীবনের সকল গান আর আমি হয়ে গেলাম শরবিদ্ধ এক পাখি। বেঁচে আছি, তবু উড়তে পারি না। সেই থেকে আর কোন ‘সোমবার’ সকালে দরোজায় কড়া নাড়ে, না।

লেখক : সাখাওয়াত হোসেন মনজুর পত্নী, প্রাবন্ধিক, কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার ঈদ ও কল্যাণময় ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে