মাতারবাড়িতে ২০২৬ সালে জাহাজ ভেড়ানোর আশা

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ

২০২৬ সাল নাগাদ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে জাহাজ ভেড়ার আশা প্রকাশ করছেন বন্দর কর্মকর্তারা।
১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়িতে এই গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হচ্ছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে। বন্দর কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের জানান, দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের এই প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। বিকালে বন্দর ভবনে জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘নিপ্পন কোয়ে’র সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন বন্দর চেয়ারম্যান। নিপ্পন কোয়ে’র সঙ্গে গত ২৩ সেপ্টেম্বর চুক্তি সই হয়েছিল। তিনি জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে। তার কার্যক্রম আজকে (গতকাল) থেকেই অফিসিয়ালি শুরু হল। বন্দর চেয়ারম্যান আরো জানান, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এখন সময়ের দাবি। আপনারা জানেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। মোট বাণিজ্যের ৯২ ভাগ কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই হয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে গতি, যেভাবে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা প্রায় শেষপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। নদীভিত্তিক বন্দরের ওপর আমাদের দেশের অর্থনীতি আর পুরোপুরি নির্ভর করার অবস্থায় নেই। সেজন্য আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে আরো বন্দরের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমাদের নতুন প্রজেক্ট পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও বে টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্থনীতির রোল মডেল করেছেন। এটার সাথে সঙ্গতি রেখে ২০১৪ সালে তিনি যখন জাপান সফরে যান, তখন দুই দেশের সরকারের মধ্যে বিগ বি চিন্তা ধারা নিয়ে আমাদের বে অব বেঙ্গল বেল্ট ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে মাতারবাড়িতে একটা গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে আমরা জাইকার অর্থায়নে নিপ্পন কোয়ে জাপানকে কনসালটেন্ট ফার্ম হিসেবে কাজের জন্য নিয়োজিত করেছি। ইনশা আল্লাহ আগামী ২০২৬ এর মধ্যে মাতারবাড়ি বন্দরের কার্যক্রম শেষ হবে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, মাতারবাড়ি বন্দরে দুই স্টেজে আমাদের কার্যক্রম শেষ হবে। স্টেজ-১ এর আরো দুইটা ধাপ থাকবে। প্রথমে কন্টেনার টার্মিনাল এবং পরে আরেকটা মাল্টিপারপাস টার্মিনাল দিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে। গ্র্যাজুয়ালি আমাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে আরো টার্মিনাল বাড়তে থাকবে। আমাদের যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে এবং আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রাম এবং কঙবাজার পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক বেল্ট গড়ে উঠছে তাতে এই অঞ্চল দেশের সামগ্রিক ব্যবসা উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। মাতারবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির কর্মকান্ড আরো বেগবান হবে।
কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়েইর টিম লিডার উতানি বলেন, আমরা মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা তৈরি ও প্রকল্প উন্নয়ন তদারকির জন্য জাপানের ৩০ জন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর সাথে বাংলাদেশের ১৮ জন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ও ২১ জন কর্মী নিয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। আমাদের টিম বন্দরের নকশা প্রণয়ন, টেন্ডার দেখাশোনা ও প্রকল্প সুপারভিশনের দায়িত্ব পালন করবে। পুরো প্রকল্পটি দুটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপে প্রকল্পের প্রণয়ন, টেন্ডার দেখাশোনা ও প্রকল্প সুপারভিশনের কাজ করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ও বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের তদারকি করা হবে। এক্ষেত্রে আজ থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়ন করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের টেন্ডার অ্যাসিস্ট্যান্সের কাজ করা হবে। পরে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্প সুপারভিশন করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম বলেন, কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান দুটি প্যাকেজের একটিতে টার্মিনালের ডিজাইন করবেন, দ্বিতীয় প্যাকেজে প্রকিউরমেন্ট করবেন। টার্মিনালের ডিজাইনের সাথে অনেক বিষয় আছে। এরমধ্যে সিসমিক সার্ভের বিষয় আছে, আমরা যেহেতু ভূমিকম্পন এলাকায় আছি, এই বিষয়টিও তারা দেখবেন। তারা পুরো প্রকল্পের টপ সুপারভিশন করবেন। কাজটা কিভাবে হচ্ছে সেটি দেখাশোনা করবেন, কোয়ালিটি মেনটেইন করবেন। টেন্ডার প্রক্রিয়াকে ওনারা এসিস্ট করবেন। ২০২৬ পর্যন্ত এই প্রজেক্টের সময়কাল আছে। ২০২৫ এর মাঝামাঝিতে এই টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। সময় যদি আরো কমিয়ে আনা যায়, তাহলে আরো দুই থেকে চার মাস কমানো যেতে পারে। এখানে ১৮ দশমিক ৫ ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারবে। ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেনার নিয়ে জাহাজ আসতে পারবে। এছাড়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল থাকবে। বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ ইকোনোমিক জোন হচ্ছে, তার ফলে প্রচুর কার্গোর ডিমান্ড আছে। এই কার্গো পরিবহন করার জন্য আমাদের নতুন বন্দরের দরকার। মাতারবাড়ি বন্দরে ৮ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডেল করার জন্য ডিজাইন করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে আরো বাড়ানো হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে জাফর আলম বলেন, ডিমান্ড এবং সাপ্লাই মাথায় রেখে কিন্তু এই বন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। আপনারা দেখবেন, আমরা ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের জেটি করছি এবং একটি মাল্টিপারপাস জেটি করছি। ওখানে যে জায়গা ছিলো, এক সময় পাঁচটি জেটি করা যেতো। কিন্তু এই ধরণের কোনো পরিকল্পনা কনসালটেন্টরা গ্রহণ করেননি। ডিমান্ড এবং সাপ্লাইকে ক্যালকুলেট করে বিনিয়োগ করলে তা উঠে আসবে সেই রকম কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। সেখানে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই জায়গাটি নদীপথে যুক্ত আছে, কিন্তু রোড এবং রেলপথ যুক্ত নেই। ফলে প্রাথমিকভাবে এখানে ডিমান্ড কম হবে। ডিপ ড্রাফটের জাহাজ সেখানে আসবে। বড় জাহাজ বন্দরে আসতে যদি ১৫ দিন লাগে, মাতারবাড়িতে যদি সেটা পাঁচদিনে চলে আসে তখন কস্ট কমে যাবে। কস্ট কমে গেলে ব্যবসায়ীরা সেখানে পণ্য আনতে আগ্রহী হবেন।
অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিজিবিলিটি এবং প্রি ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য আমাদের সরকারকে কোনো খরচ করতে হয়নি। তবে এই কনসালটেন্সির জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা জাইকা থেকে ঋণ নিয়েছি শূণ্য দশমিক শুণ্য এক শতাংশ সুদে। ২০ বছরে তা শোধ করতে হবে। খুবই সহজ শর্তে ঋণ। এই কনসালটেন্সিতে মোট ২৩৪ কোটি টাকা খরচ হবে। ২৬ কিলোমিটার রাস্তাসহ প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা শুধু বন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিবে এবং বাকি টাকা ঋণ নেয়া হবে। আমরা যে টাকা দেব সেটি জমি কেনার জন্য। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২২৮ একর জমি যেটা আমাদের প্রথম ফেইজের জন্য দরকার সেটি অনুমোদন করেছেন। আমরা কঙবাজার জেলা প্রশাসনকে জমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা হস্তান্তর করবো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোট কারচুপি ধামাচাপা দিতেই বাসে আগুন
পরবর্তী নিবন্ধমহানগর বিচারিক হাকিমদের আদালত পুনর্বণ্টন