মহাত্মা গান্ধীর অহিংসনীতি ও প্রাসঙ্গিক কথা

মোহাম্মদ আমান উল্লাহ খান | মঙ্গলবার , ২০ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

ÒYou shall have to divide my body before you divide India.”
ÒTruth and nonviolence I swear.”
I have cried in anguish as the first communal killing had opened in abyss between India’s Hindu and Muslim communities. Truth and nonviolence to which I swear and which have sustained me for fifty years
-Freedom at midnight. Page- 21

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্কালে ভারতকে অবিভক্ত রাখার প্রচেষ্টায় এবং স্বাধীনতা অর্জনের পরে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা প্রশমনের উদ্দেশ্যে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী উপরোক্ত মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন।
আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতা এবং সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। কেবলমাত্র ভারতে নয়, পৃথিবীর বহু শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রপতি, জননায়ক, দার্শনিক ও ধর্মীয় নেতা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির অনুসারী। যার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যাণ্ডেলা, ডেসমন্ট টুটু, পোলান্ডের লেস ওয়ালেসা, আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং, তিব্বতের দালাইলামা, মিয়ানমারের উনু, এমনকি মিয়ানমারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আংসানসুচি পর্যন্ত মহাত্মাগান্ধীর অনুসারী বলে পরিচিত। যদিও বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তিনি পৃথিবীর সর্বত্র কঠোরভাবে সমালোচিত।
ভারত স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী আমরণ অনশনব্রত পালন অবস্থায় নাথুরাম গডসে নামক একজন উগ্র হিন্দুবাদীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ঐ সময়ে ভারতের সর্বত্র চরম সাম্প্রদায়িক সহিংস্রতা চলমান ছিল। যা তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এবং প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর আপ্রাণ প্রচেষ্টায়ও প্রশমিত হচ্ছিল না। মহাত্মা গান্ধী এ জঘন্য হত্যা যজ্ঞে চরমভাবে ব্যথিত হয়ে তাঁর শেষ প্রচেষ্টা স্বরূপ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অনশনব্রত পালন করেছিলেন। এ অবস্থাতেই নাথুরাম গড়সে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে তার নিকটবর্তী হওয়ার ছলনায় সুযোগবুঝে তার পোশাকের আবরণে লুকাইত পিস্তল দিয়ে পরপর তিনটি গুলি করেন। পিস্তলের তিনটি বুলেটই তাঁর শীর্ণ শরীর ভেদ করে এবং সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এ মর্মান্তিক ঘটনার খবর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পান তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীর কাছে প্রায় সাথে সাথেই। শোনামাত্রই তাঁর মুখ থেকে প্রথম যে প্রশ্নটি নির্গত হয় তা হলো- কে একাজ করলো? সেক্রেটারী জওয়াব দিল- আমি জানি না স্যার। এমন বেদনা মুহূর্তেও তিনি মনে মনে কামনা করলেন, লোকটি যেন একজন হিন্দু হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে কোন মুসলমান যদি একাজ করে থাকে তাহলে আগামীকাল থেকে সারা ভারতে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডে শুরু হবে যা আয়ত্তে আনা সম্পূর্ণ অসম্ভব হবে।
তিনি দ্রুততম বেগে গান্ধীর আবাসস্থল বিড়লা ভবনের দিকে রওয়ানা হলেন। দেখলেন সেখানে বাড়ির সম্মুখে অনেক শোকার্ত জনতা অপেক্ষমান রয়েছে। তিনি নিকটবর্তী হলে জনতার একজন বলে উঠলো- সম্ভবত কোন মুসলমানই একাজ করেছে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন সাথে সাথে উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন- না, একজন হিন্দু একাজ করেছে। জনতা তাঁকে রাস্তা করে দিল, তিনি ভিতরে প্রবেশ করে দেখলেন- পণ্ডিত নেহেরু দেওয়ালের দিকে মুখ করে অশ্রু বিসর্জন করছেন, আর পণ্ডিত বল্লব ভাই প্যটেল, মাওলানা আজাদ স্তম্ভিত অবস্থায় কামরার মেঝেতে বসে আছেন। তিনি ঘরে প্রবেশ করে নিশ্চিত হলেন- হত্যাকারীর নাম নাথুরাম গড়সে, সে একজন ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান। তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হলেন।
সেদিন দিবাগত রাতে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের ব্যবস্থাপনায় সব ভারতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে খবরটি প্রচারিত হল, যার প্রত্যেকটি শব্দ অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সমাবিষ্ট হয়েছিল, আর তা ছিল-
Mahatma ghandi was assassinated in New Delhi at twenty minutes passed five this afternoon. His assassin was a Hindu.
তার মৃত্যুর খবর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পৃথিবীর সর্বত্র প্রচারিত হলো যা শুনে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও অঙ্ক শাস্ত্রবিধ জনাব লর্ড বান্ট্রেড রাসেল মন্তব্য করেছিলেন- It is dangerous to be too good.
যে মহৎ উদ্দেশ্যে মহাত্মা তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অনশনে ছিলেন, তার মৃত্যুর সাথে সাথে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হলো। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। ঐ ভয়ঙ্কর কাজে যারা লিপ্ত ছিল অতি উৎসাহে; তারাও সবকিছু ভুলে বুকফাটা ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়লো। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতীয় জনগণের তখন রোদন ছাড়া আর কিছুই করার রইল না।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রপথিক এক নিষ্ঠুর ঘাতকের হাতে প্রাণ দিলেন। তার অহিংস নীতি বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা নিরত অবস্থায় ঘাতকের পিস্তলের বুলেট তার শীর্ণ মানবিক দেহটাকে ছেদন করতে পেরেছিল, কিন্তু তার মহৎ আদর্শকে ছেদন করতে পারে এমন বুলেট আজও আবিষ্কার হয় নি।
তাঁর সে মহৎ আদর্শ যুগযুগ ধরে বেঁেচ থাকল তার অনুসারীদের মাঝে। সে আদর্শ মাথায় ধারণ করে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু, তার উত্তরসূরী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী এমনকি কংগ্রেস বিরোধী জনতা দলের মন্ত্রী অটল বিহারী বাজপাই, মোরারজী দেশাই পর্যন্ত সে মহৎ আদর্শকে ধারণ করেছিলেন সশ্রদ্ধচিত্তে।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাহেব তার প্রথম ব্যতিক্রম। জনাব মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেকার ইতিহাস খুবই “গৌরব উজ্জ্বল”। তিনি ইতোপূর্বে তার নিজ রাজ্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সে স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটানোর অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রে পরিদর্শনের ভিসা লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সময়ের পরিবর্তনে বর্তমানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে এ সুযোগে তার পূর্বেকার ধারণ করা মহৎ উদ্দেশ্যকে আইনগতভাবে ক্ষমতায়ন করার ‘মহৎ’ উদ্যোগে লিপ্ত হন।
তিনি সংশোধিত ‘নাগরিক আইন’ নামে একটি আইন পাশ করানোর জন্য বিধান সভায় বিল উত্তোলন করলেন। যা ভারতের সংবিধানের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থি বলে মহাত্মা গান্ধীর ভারতীয় কংগ্রেস দল ভারতের উদার নৈতিক আ’ম আদমী পার্টি, মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস এবং শিখ নাগরিকদের প্রতিনিধিগণ এ বিলের প্রবল প্রতিবাদ করে। সংশোধিত নাগরিক আইনের মূল কথা ছিল- যে সকল হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভারতে প্রবেশ করবে তাদেরকে ভারতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আর যে সকল মুসলমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বা এর কিছু পূর্বে ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের ভারত থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে।
উপরোক্ত রাজনৈতিক দল সমূহ এবং মানবিক সংগঠন সমূহের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদী বিধান সভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিতে বিলটি পাশ করায়ে আইনে পরিণত করতে সক্ষম হন।
এ আইনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্রীকে ভারত থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হলো। ভারতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া সম্মানিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাছাড়া এ জঘন্য কানুনের কেরামতে আসামে বংশানুক্রমিক বসবাসরত বহু মুসলমান নাগরিক তাদের ভোটের অধিকার হারিয়েছে। পশ্চিম বাংলার মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এবং তার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং মুখ্যমন্ত্রী ক্রুব্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেন- একজন মুসলমানও ভারত থেকে কোথাও যেতে পারবে না।
আমরা আশা করবো এক সময়ে যে দেশের প্রশাসন ও প্রশাসকরা সমস্ত বিশ্বে মানবতা ও মহত্বের জন্য সম্মানিত শ্রদ্ধার পাত্র ছিল- যে দেশ এবং জাতি ছিল সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক, সে দেশের সে সুনাম ফিরে আসবে। সত্যের জয় আবশ্যম্ভাবী।
লেখক : প্রবন্ধকার ও জীবনী লেখক ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবাসিকে গ্যাস সংযোগের প্রয়োজনীয়তা
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল