আবাসিকে গ্যাস সংযোগের প্রয়োজনীয়তা

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২০ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

কয়েকদিন আগে নারায়নগঞ্জে একটি মসজিদে ফ্লোরের নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাসের লাইন হতে নির্গত গ্যাস বিস্ফোরণে ৩৪ জন মুসল্লি নামাজরত অবস্থায় মারা যায়। বিষয়টি খুবই হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক। এই নিয়ে সরকার অনেকগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কেউ কেউ এই বিস্ফোরণের জন্য তিতাস গ্যাসকে দায়ী করেছেন। যেই লাইন হতে গ্যাস নির্গত হয়েছে সেই লাইনটি অপসারণ বা ফুটোটি মেরামতের জন্য তিতাসে আবেদন করার পরেও তা মেরামত করা হয় নি। এটি প্রায় ১৬ বছর আগের পরিত্যক্ত একটি গ্যাস লাইন যা থেকে বছরের পর বছর ধরে গ্যাস নির্গত হয়েছে। এই রকম পরিত্যক্ত গ্যাস লাইন দেশে আরো আছে। যদি কখনো সেগুলোতে বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনা ঘটে তখন তা কর্তৃপক্ষের নজরে আসবে, না হলে নয়। বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক।
গত ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে দেশে সব রকমের গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এতে কারণ হিসাবে গ্যাসের অপ্রতুলতা ও ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে গ্যাসের ঘাটতি মিটাতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) গ্যাস আমদানির জন্য মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরী করা হয়। মহেশখালী হতে ন্যাশনাল গ্রীড পর্যন্ত চারটি গ্যাস লাইন স্থাপন করা হয়। যার ডেলিভারি ক্যাপাসিটি ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বলা হয়েছিল এলএনজি আমদানি শুরু হলে, আবারো নতুন করে শিল্প ও আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু হবে। এলএনজি আমদানি শুরু হলে শিল্পের জন্য গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু আবাসিক গ্রাহকদের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ থাকে। এই সুযোগে তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় অবৈধভাবে দশ লক্ষ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। বিষয়টি সবার চোখের সামনে করা হলেও এ নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না। সংযোগ বন্ধ থাকলে তিতাস গ্যাস কোম্পানির কতিপয় অসাধু কর্মকতা কর্মচারীদের নগদ লাভ। কেননা, ২০০৯ সালে সরকার গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ করলেও তিতাসে অবৈধ সংযোগ থেমে নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শিথিলতায় দিন দিন অবৈধ সংযোগ আরো বেড়েছে। এই সুযোগে তিতাস গ্যাস ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় ৯ লাখ ৬৬ হাজার আবাসিক গ্রাহককে সংযোগ দিয়েছে। যার মধ্যে ৭ লাখ অবৈধ গ্রাহককে বোর্ড সভায় বৈধতা দেয়। বাকী ২ লাখ ৬৬ হাজার নতুন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার তথ্য তিতাসের সার্ভার বা তথ্য ভান্ডারে যুক্ত করা হয়। যদিও এসব গ্রাহক বোর্ডসভায় বৈধতা পান নি। তবে সংযোগ পাওয়া ৯ লাখ ৬৬ হাজার গ্রাহকই ব্যাংকে নিয়মিতভাবে তাদের প্রতি মাসের গ্যাস বিল জমা দিচ্ছেন। সরকারিভাবে সংযোগ বন্ধ থাকার পরেও অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে আবার বোর্ড সভায় তার অনুমোদন দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা! আরো চমকপ্রদ খবর হচ্ছে, আগের প্রায় দশ লাখ সংযোগ দিয়েও তাঁরা বসে নেই। আরো নতুন নতুন অবৈধ সংযোগ দেওয়ার জন্য নতুন অবৈধ গ্যাস লাইন স্থাপন করে চলেছেন। যার দৈর্ঘ্য এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪৫কিলোমিটার। সেই অবৈধ লাইনে আরো নতুন অবৈধ গ্রাহক আছে কয়েক লাখ। এরা নিয়মিত গ্যাস ব্যবহার করছে। যাদের বছরে বিল আসে (৯৭৫ টাকা হারে) ১১৭০ কোটি টাকা। বছরে ১১৭০ কোটি টাকার আয় হতে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। ভেবে দেখুন শুধু তিতাস গ্যাসে মাসে কম করে আয় হয় ১১৭০ কোটি টাকা। অথচ ঐ সব গ্রাহক মাসে মাসে বিল পরিশোধ করেন তিতাসের লোকজনের হাতে, সরকারি কোষাগারে নয়। এই জন্য তিতাসের সিস্টেম লস হয় ৫.৭১%(২০১৮-১৯ সালে)। যার অফিসিয়াল পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এতবড় একটা পুকুর চুরি হচ্ছে দেশের রাজধানীতে একেবারে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সামনে।
প্রশ্ন হলো, সরকারিভাবে বন্ধ থাকার পরেও যদি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ৯ লাখ ৬৬ হাজার গ্যাস সংযোগ দিয়ে বোর্ড সভায় বৈধতা দিতে পারেন, তাহলে দেশের অন্যান্য এলাকা বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকজনের দোষটা কোথায়? চট্টগ্রামের লাখ লাখ গ্রাহক ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়ে গ্রাহক সংকেত নাম্বার পেয়েও কেন গ্যাস সংযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে? কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীতভাবে জানতে চাই, সংযোগই যদি না দিতে পারেন তাহলে কেন গ্রাহককে ডিমান্ড নোট ইস্যু করলেন ও ডিমান্ড নোটের টাকা জমা নিলেন? এটা কি বৈষম্য নয়? এই বৈষম্যের অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? প্রশ্ন হলো, যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অবৈধ সংযোগ নেন নি। তাদের অপরাধটা কোথায়?
দেশে এখন লাইনের গ্যাসের বৈধ গ্রাহক হচ্ছে প্রায় ৩৮ লাখ। যার মধ্যে ২ লাখ গ্রাহকের মিটার রয়েছে, যাদের মাসে বিল আসে মিটারের রিডিং অনুযায়ী প্রায় ৬০০-৮০০ টাকা। অবশিষ্ট ৩৬ লাখ গ্রাহক হচ্ছে মিটারবিহীন, যাদের মাসে ফিঙড বিল ৯৭৫ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে সংযোগ ছাড়া এলপিজি ব্যবহার করেন প্রায় ৩৫ লাখ আবাসিক গ্রাহক। এর মধ্যে গ্যাসের সংযোগ লাইন এরিয়ার মধ্যে আছে এমন গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই ১৫ লাখ গ্রাহকের সংযোগের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।এতে অবৈধভাবে নেয়া দশ লাখ গ্রাহকের সংযোগের বৈধতাও পেতে পারে। যাতে করে সরকার ঐ দশ লাখসহ মোট ২৫ লাখ গ্রাহক হতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেতে পারেন। যদিও নতুন সংযোগের ব্যাপারে গ্যাস কোম্পানিগুলোর অনীহা রয়েছে। কারণ নতুন সংযোগ দেওয়া শুরু হলে তাদের মাসে মাসে পাওয়া অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে যাবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্যলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তাই এই বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একমাত্র তিনি উদ্যোগ নিলে তিতাসের এই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। তাই অনতিবিলম্বে চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া হোক। কারণ তিতাসে যে দশ লাখ অবৈধ সংযোগ আছে সেই সংযোগের মাসিক বিলগুলি সরকারি কোষাগারে জমা হলে গ্যাসের সিস্টেম লস তথা চুরি কমবে। এতে করে দেশ ও জাতি লাভবান হবে। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো/ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৪ সেপ্টেম্বর ও ১৫ অক্টোবর ২০২০)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপকৃত হবো আমরা উপকৃত হবে দেশ
পরবর্তী নিবন্ধমহাত্মা গান্ধীর অহিংসনীতি ও প্রাসঙ্গিক কথা