ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

কস্ট অফ্‌ ওয়ার

১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামে মার্কিনীরা পরাজয় বরণ করে। বর্তমান রাজধানী হো চি মিন সিটির নাম ছিল সায়গণ, সায়গনে মার্কিন সৈন্যদের সরানোর জন্য একটা বড় জাহাজ নোঙ্গর করে। আমেরিকান সৈন্যরা জাহাজে উঠার জন্য মোটা দড়ি লাগানো হয়েছিল। কাবুল বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার জন্য যেরকম হুড়াহুড়ি পড়েছিল ঠিক সেরকম হুড়াহুড়ি পড়েছিল জাহাজে উঠার জন্য। অনেক সৈন্য পানিতে সাঁতরে জাহাজে উঠেছিল। সৌভাগ্য দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো ঘটনারই টেলিভিশন লাইভ দেখেছিলাম। ১৯৭৫ সালে মার্কিনিদের সায়গন থেকে পালানোর দৃশ্য লাইভ দেখেছিলাম পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া ছাত্রাবাসে। এক বিংশ শতাব্দীর থ্রিলার ফিল্ম এর মতো ঘটনা কাবুলের পতন ও এয়ারপোর্টের মানব এয়ারলিফটিং। কাবুল পতনের হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল বিমান থেকে ঝুলন্ত মানুষের মৃত্যু, সর্বশেষ মার্কিন সেনার অবনমিত বদনে হেঁটে প্লেনে আরোহণ, তার থেকেও বড় ক্লাইমেক্স ছিল সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায় এক পঙ্গু সেনার আক্ষেপ ুএটা দেখার জন্য কি ২০টা বছর অপেক্ষা করেছিলাম?
সেরাথ হার্ভাড কেনেডি স্কুল ও ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটা প্রজেক্ট শেষ করেছে । যার নাম ‘কস্ট অফ ওয়ার’ বাংলায় যুদ্ধের মূল্য।
২০০১ সালের ১/১১ এর আগে আমেরিকা নিরাপদ ভূমি ছিল। ১/১১ আমেরিকা হঠাৎ আবিষ্কার করল তার সরাসরি শক্র হচ্ছে আল কায়দাসহ বহু ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীর নিরাপদ স্থান ছিল মার্কিনিদের মতে আফগানিস্তান। জর্জ বুশ মার্কিনিদের আবেগকে উসকে এক ফর্মুলা দিল-বিপদ এসেছে, আমেরিকার সমগ্র জাতি ক্রোধান্বিত, সব টেরোরিস্ট না মারা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। বুশ দাঙ্গাবাজ হলেও ভালো শিক্ষিত। তাই আবিষ্কার করল অীরং ড়ভ বারষং-শয়তানের গ্রুপ। ইরান-ইরাক নর্থ কোরিয়া। অতএব যুদ্ধ চালাও। সমপ্রতি মার্কিন সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড্যানিয়েল ডেভিস মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ নিয়ে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখেন। ড্যানিয়েল এর ভাষায় মার্কিন জেনারেলদের মাঝে জেনারেল ম্যাকমাস্টার ও জেনারেটর পেনেটার ধিৎ ধফফরপঃ বা যুদ্ধ আসক্ত ব্যক্তি। ট্রাম্প ও ওবামা দু’জনকেই আফগানিস্তানের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে প্ররোচিত করে।
হার্ভাড ইতিহাসবিদ জেমস কোপেনবার্গ একটা মজার কথা বলেছেন। বোকাদের থেকে কোন কিছুর উত্তর খুঁজে লাভ নেই। কিন্তু উপরোক্ত দুই যুদ্ধ আসক্ত জেনারেল কিভাবে ওবামাকে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর প্রয়োজন বোঝাতে সক্ষমতা বুঝে আসে না। কারণ ওবামাকে একজন বুদ্ধিদীপ্ত প্রেসিডেন্ট মনে করা হয়। আসলে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা অনেকেই অস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ধনবাদী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য মার্কিন মুলুকে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ।
যা হোক পরিসংখ্যান মতে কষ্ট অফ ওয়ার কত? আফগান যুদ্ধে মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে ৬৩০৭(সর্বশেষ বিমান বন্দরে নিহত ১৩ জন বাদে) ৩৮৪৬ জন ঠিকাদার নিহত অন্যান্য দেশের সেনা মৃত ২৪৬১ জন। পাল এবং সৈন্য নিহত ৫২ হাজার জন। আমেরিকা সহযোগী আফগান সেনা ও পুলিশ নিহত ৬৬ হাজার। বিভিন্ন এনজিও কর্মী নিহত ৪৪৫ জন। বহু দেশি বিদেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তন্মধ্যে পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত রয়টার এর চিত্র সাংবাদিক, ভারতীয় দানিশ সিদ্দিকীও রয়েছেন। আফগানিস্তানের ৮০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। যুদ্ধে ছিলেন না এমন ৬৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
যে শেষ আমেরিকান সৈন্য অবনত ও হতোদ্যম হৃদয়ে প্লেনে ওঠার জন্য এগিয়ে আসছিল তার নাম ক্রিস্টোফার। অত্যন্ত মেধাবী ও শিক্ষিত এক কমান্ডিং জেনারেল। ২০২০ সাল থেকে আফগানিস্থানে ছিলেন। এইসে না মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক পাস করার ২১ বছর পর ২০১৩ সালে হার্ভাড থেকে ফেলোশিপ অর্জন করেন।
ক্রিস্টোফার জার্মানিতে পৌঁছে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন ঐড় িওঞ ধষষ যধঢ়ঢ়বহবফ? এটা কিভাবে হল। আরেকজন মার্কিন অফিসার বললেন- এটা কি হবে তা সে দশ বছর আগেই টের পেয়েছিল।
আসলে মার্কিনীদের ইরাক অভিযান থেকে আফগানিস্তান সবখানেই তারা স্থানীয় অনুভূতিকে আমলে না নিয়ে যুদ্ধবাজ জেনারেল, তেল ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্রোকার ও পার্টির জন্য চাঁদা নেওয়া রাজনীতিবিদ, এই চক্রের যোগসাজশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন সাধারণ করদাতাদের পয়সায় বিদেশে টহ- বহফরহম ধিৎ্ত-অবিরাম যুদ্ধ চালানোতে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা এখন মাত্র মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। জযবঃড়ৎরপ (উন্নাসিক ধারণা) দিয়ে যুদ্ধ হয় না। আর যুদ্ধের খরচ? আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে অস্ত্রশস্ত্র রাখার জন্য কেবল মাটির ঘর রয়েছে সেখানেও মার্কিন সৈন্যরা ঞবীধং জরন বুব ঝঃবধশ (এক ধরনের সুস্বাদু কাবাব) আনতে হয়েছে প্যারিস থেকে। মার্কিনিরা আফগান সেনাদের দেশরক্ষায় ট্রেনিং দিলেও দেশে রাজনীতিবিদ আমলাদের দুর্নীতির কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন কমিটমেন্ট গড়ে ওঠেনি। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছে তালেবানরা। সৈন্য, স্থানীয় কর্মচারী সবাইকে তারা টাকা দিয়ে কিনে ফেলে। কেউই তালেবানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি। পয়সা দিয়ে বশ করে যুদ্ধে জেতার পুরনো কৌশল তালেবানরা সহজেই সফল হয়।
২০ বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধের সামরিক, ঐতিহাসিক, প্রজন্মের মানসিক দুর্গতির পড়ংঃ কোনো গবেষক বের করতে পারবেনা। মার্কিনীরা তো চলেই গেল, তালেবানরা ফিরে এলো, তারপর?
বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যে সমস্ত রাষ্ট্রের, সেখানে জাতীয় ঐক্য কদাচিৎ দেখা যায়। আফগানিস্থানে তা কখনো ছিল না। রাজতন্ত্রের আমলেও ছিলনা। ভবিষ্যতে কি হবে? জাতি ছয় জাতি মিলে বুদ্ধি করছে আফগান রাষ্ট্রের টাকা বন্ধ রেখে সেখানে গণতন্ত্র হবে না, সুশাসন ও হবে না। অশান্তির দুষ্টচক্র থেকে এইদেশ কখন মুক্ত হবে তা দেখার অপেক্ষায়।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘তুমি যতদূর পিছনে তাকাবে, ততদূর সামনে দেখতে পাবে’
পরবর্তী নিবন্ধবন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভিডিও চ্যাট অ্যাপ হাউজপার্টি