ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৫ জুলাই, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

লক্ষ্ণৌ যোগী আদিত্যনাথের শাসনাধীন উত্তর প্রদেশের রাজধানী। লক্ষ্ণৌ বর্তমানে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেবার জন্য বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছে। এই বর্বর বর্তমানের বিপরীতে লক্ষ্ণৌ শহরের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। দিল্লির অলি গলি যেমন ইতিহাসের অনেক ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত তেমনি লক্ষ্ণৌতেও রয়েছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনার কেন্দ্রস্থল।

মোগল আমলের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এসব স্থানীয় শাসকরা স্ব স্ব স্থানে বিরাট লেগেসি রেখে যান। লক্ষ্ণৌতেও গড়ে ওঠে এক উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা। লক্ষ্ণৌ সংস্কৃতি প্রায় দুশ বছর বিরাজ করে। এটাকে বলা হয় নবাবী সংস্কৃতি। লক্ষ্ণৌর নবাবরা বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করেন যেগুলো দিল্লির মোগল স্থাপনার বিপরীতে টেক্কা দেয়। যেমন বিশালাকৃতির বড় ইমামবড়ো মতিমহল, রুমি দরজা, লন্ডনের আদলে ক্লক টাওয়ার ইত্যাদি৷ লক্ষ্ণৌর নবাবদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন নবাব ওয়াজি আলী শাহ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় সবচেয়ে বেশি পরিকল্পিত যুদ্ধ হয়েছে লক্ষ্ণৌতে। দিল্লিতে যুদ্ধ থেমে যাবার পর আরো দুই বছর লক্ষ্ণৌতে তখন নবাব ছিলেন ওয়াজেদ আলী শাহ। তার দ্বিতীয় পত্নী ইতিহাসে হযরত মহল নামে খ্যাত। এই বেগম সাহেবের নেতৃত্বে অযোধ্যার হিন্দু মুসলিম একত্রে ব্রিটিশদের প্রতিহত করতে থাকে। ব্রিটিশদের হাতে অযোধ্যার পতন হলে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে কলকাতায় নির্বাসন দেওয়া হয়। নবাব গঙ্গা নদী দিয়ে কয়েকটি বজরা নিয়ে নির্বাসন যাত্রা করেন। এইসব বজরা নৌকায় নবাবকে নর্তকী, কবি, গায়ক, হরেক রকম রান্নার হরেক রকম বাবুর্চি নিয়ে যাবার অনুমতি দেয় ব্রিটিশরা। এই নবাবকে নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। তার নাম “শতরঞ্জকি খিলাড়ি” এটার ইংরেজি ভার্সন ছিল The chess player বা বাংলায় দাবা খেলোয়াড়ি। নবাব ওয়াজেদ আলী ছিলেন একজন খেয়ালী, সৌখিন নবাব। কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকায় নবাবের সফর সঙ্গীরা সংস্কৃতি, গানে, নৃত্যে, গজল, আভিজাত্যে এক মিনি লক্ষ্ণৌ গড়ে তোলেন। অনেকে জানে না যে কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা নবাব ওয়াজেদ আলী সাহেবের সৃষ্টি। এটাই বিশ্বের প্রথম চিড়িয়াখানা। ইউরোপীয়রা নবাবের আমন্ত্রণে এই চিড়িয়াখানায় এসে তা দেখে বিস্মিত হন।

খাদ্যাভ্যাসে কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানি মোগল ও মধ্য এশিয়ার রান্না তালিকার হলেও ভোজন রসিকদের বহু আকাঙ্ক্ষিত কাচ্চি বিরিয়ানী একান্তভাবেই নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর সৃষ্টি। কাচ্চি বিরিয়ানিতে আলু দেয়ার প্রচলনও তিনিই করেন। তার স্ত্রী হযরত মহলকে ইংরেজরা নেপালে নির্বাসিত করে ও সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করলে ব্রিটিশরা অজ্ঞাত স্থানে তাকে সমাহিত করে। লক্ষ্ণৌতে দিলখুশা প্রসাদ নামে এক বিশাল প্রাসাদ আছে গোমতী নদীর তীরে। নবাব সাদত আলী খানের বন্ধু মেজর গোর এই প্রাসাদ নবাবদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ রূপে নির্মাণ করেন। এটি বিলাতের নর্থমবার ল্যান্ডের সিয়াটিন ডেলাভাল হল এর স্থাপত্যে নির্মিত। দিলকুশা প্রাসাদের বাগানটা অতি বৃহৎ ও এখনো সাজানো গোছানো আছে। কিন্তু প্রাসাদটি ভগ্ন জীর্ণ দশায়, এই প্রাসাদে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীরা গোলাগুলি করে। পুরো লক্ষ্ণৌ জুড়ে সিপাহীদের গুলিতে ক্ষত বিক্ষত বহু বিল্ডিং এখনো রক্ষিত আছে। দিলকুশা বিল্ডিং এর বাগান এর গোমতী নদীর তীরে একটি অভাবনীয় মৃত্যুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বলে স্থানীয়দের মধ্যে জনশ্রুতি আছে। প্রতিবছর ১৬ই অক্টোবর সকাল ৬ টা নাগাদ দিলকুশা প্রাসাদ এলাকায় এই ভৌতিক কান্ড ঘটে। অনেকে ভয়ে যায়না। অনেকে ওৎ পেতে দেখে ব্রিটিশ আমলে ঘটা একটা ঘটনার ভৌতিক পুনঃ প্রকাশ।

ঘটনাটা এক শ্বেত তরুণীকে নিয়ে। দুই শ্বেত ইউরোপিয়ানের ডুয়েল বা দ্বৈত যুদ্ধ। তরুণীটি লক্ষ্ণৌর এক শ্বেত ইউরোপিয়ান ডাক্তারের মেয়ে। তার নাম এনাবেলা। এনাবেলা অত্যন্ত সুন্দরী ছিল। সে ভালো নাচ গান করত, আর ঘোড়া চালনায় পারদর্শী ছিল। তৎকালীন অভিজাত পার্টি গুলোর প্রধান আকর্ষণ ছিল এনাবেলা হাডসন, এনাবেলা ছিল অনেক পুরুষের একজন আকাঙ্ক্ষিত নারী। ইতালি থেকে নবাবের পোর্টেট আঁকার জন্য এলিংওয়ার্থ নামে এক চিত্রশিল্পী এসেছিলেন লক্ষ্ণৌতে। ভদ্রলোক নবাবের ছবি আকার ফাঁকে এনাবেলা সুন্দরীরও ছবি আঁকার ফরমায়েশ পান। স্বভাবতই দুজনের প্রেম গড়ে ওঠে। অপরদিকে লক্ষ্ণৌর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাপ্টেন চার্লস ব্রুস নামে এক সুদর্শন অফিসারও এনাবেলার সাথে প্রেম করত। দুই শ্বেতাঙ্গ প্রায় সময় এনাবেলাকে নিয়ে কথা কাটাকাটি করত। একদিন ব্রুস এলিংওয়ার্থকে খুব গালিগালাজ করলে দুজন ডুয়েল এ রাজী হয় অর্থাৎ মল্লযুদ্ধ হবে পিস্তল দিয়ে।

মল্লযুদ্ধে একজন রেফারি লাগে। এলিংওয়ার্থ লক্ষ্ণৌতে কাউকে চিনত না। সে হুগ ড্রুমন্ড নামে এক ব্রিটিশকে রেফারি হিসেবে হাজির করে। ‘ডুয়েল দুজনই একজন আরেকজনের থেকে ১৪ ফুট দূরে পিছন দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ‘ফায়ার’ বলার সাথে সাথে দুজন পিস্তল চালায়, ব্রুস অভিজ্ঞ সেনা। তার গুলি এলিংওয়ার্থর বুকে লাগে। কিন্তু তার গুলি ব্রুস এর গায়েই লাগেনি। কিন্তু ঝোপঝাড় থেকে তৃতীয় একটি গুলির শব্দে ব্রুসও লুটিয়ে পড়ে। এই তৃতীয় গুলিটা করেছিল এনাবেলা নিজে। কারণ এনাবেলা মনে করেছিল যে দুই জনই তাকে পরে কষ্ট দিবে। এনাবেলা দুজনের কাউকেই ভালোবাসতো না। এখানেই ঘটনা শেষ। কিন্তু প্রতি বছর নাকি একই জায়গায় ১৬ অক্টোবর ভোর ৬ টায় এনাবেলা, এলিংওয়ার্থ ও ব্রুস নাকি ছায়া হিসেবে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখায়। এটাকে অনেকে সাহিত্য কর্মে Ghost of Dilkusha নামে অভিহিত করেছেন। সত্যজিৎ রায় গুপী বাইনবাঘা বাইন ফিল্ম এ E M Foster তার স্মরণীয় গ্রন্থ A passage to India তেও এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

লক্ষ্ণৌ এর অলিতে গলিতে নবাবদের অনেক কাহিনী জড়িত। মানুষ এখনো তা স্মরণ করে। দিলকুশা প্রাসাদের এনাবেলা সুন্দরী ও তার দুই প্রেমিকের প্রেতাত্মাও হয়তো এখনো গোমতী তীরে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাজিরা দেয় প্রতিবছর ১৬ই অক্টোবর ভোর ছয়টায়।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদলিল রেজিস্ট্রি প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধচিকিৎসা শ্রমিকের পথচলা : ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির উৎসের সন্ধানে