চিকিৎসা শ্রমিকের পথচলা : ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির উৎসের সন্ধানে

ডা: হাসান শহীদুল আলম | মঙ্গলবার , ৫ জুলাই, ২০২২ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

ওষুধ কী?

ওষুধ হচ্ছে এমন রাসায়নিক দ্রব্য যা প্রয়োগে প্রাণীদেহের স্বাভাবিক ক্রিয়া প্রভাবান্বিত হয়, যার আরোগ্য ও প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে অথবা যা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। যেহেতু অসুস্থতা হবে, অতএব উপশমের জন্য ওষুধ গ্রহণ করতেই হয়। তাই ওষুধ একটি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য। নীচের সংবাদচিত্রটি দেখা যাক।

বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার ১৪২২ সালের বার্ষিক সংখ্যায় প্রকাশিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের একটি পরিবারকে গড়ে মাসিক আয়ের ৯ শতাংশ ব্যয় করতে হয় চিকিৎসার পেছনে। আর দরিদ্রদের ক্ষেত্রে এই ব্যয় ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে আবার ৬৬ শতাংশ চলে যায় ওষুধ ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় (ফক্স থ্রি ডট কম, ত্রিশে মার্চ, ২২)’। দেখা যাচ্ছে ওষুধ কিনতে গিয়ে দরিদ্রদের ভাতের পয়সা থাকছে না। অতএব ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।

ওষুধের মূল্য কিভাবে ঠিক করা হয়ঃ

কাঁচামাল এর দাম, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং খরচ, বিপনন খরচ এবং কোম্পানীর লাভ ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির কারণসমূহঃ

. সরকারের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তঃ

. ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়াঃ ‘১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভুল করে ওষুধের দাম নির্ধারনের ক্ষমতা কোম্পানীর হাতে তুলে দেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সেই ভুলের সংশোধন করেননি। যে কারণে ওষুধের আজ এতো দাম (একুশে পত্রিকা, ২৬০৩২২)’

) ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ক্ষমতা সীমিত হওয়াঃ ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে জানা গেল, এক হাজার ৪০০টি জেনেরিকের ২৭ হাজার ব্রান্ডের ওষুধ তৈরী করা হয় দেশে। এর মধ্যে কেবল ১১৭ টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে (সোনালী নিউজ, ১৯১২১৬)’

) জীবন রক্ষাকারী ওষুধের (এসেনশিয়াল ড্রাগস) তালিকা বৃদ্ধি না পাওয়া এবং ওষুধনীতি ২০০৫ কার্যকর না হওয়া।

) ওষুধ প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তাঃ

) রপ্তানীকারক দেশে কাঁচামালের মূল্য কমলেও বাংলাদেশে ওষুধের মূল্য কমানো হয়নাঃ ‘২০১৯ সালের ২২শে জুলাই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একটি নথি থেকে জানা যায়, এক হাজার টাকার কাঁচামাল দিয়ে ৫০ হাজার পিস ওষুধ তৈরী হলে একটি ওষুধের কাঁচামালের (সক্রিয় উপাদান) খরচ পড়ে দুই পয়সা। বাজার ঘুরে দেখা গেল, নামীদামী ব্রান্ডগুলোর ওমিপ্রাজল ২০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের প্রতি পিসের সর্বোচ্চ খুচড়া মূল্য গড়ে ৫ টাকা। ২০১৯ সালের ২২ শে জুলাইয়ের মাসখানেক পরে বিশ্ব বাজারে ওমিপ্রাজল ৮.% পেলেট নামক কাঁচামালটির দাম ৪ ডলার কমে প্রতি কেজি ৮ ডলার হয়েছে বলে ওষুধ প্রশাসনের নথি থেকে জানা গেছে। সেই দামে আনা কাঁচামাল দিয়ে বানানো একেকটি ওষুধে সক্রিয় কাঁচামালের পিছে খরচ পড়েছে দেড় পয়সারও কম। কিন্তু ২০১৯ সালের পর ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধের দাম কোম্পানীগুলো কমায়নি (দি রিপোর্ট ডট কম,০১০৪২২ )’

) দুর্নীতিগ্রস্ত ওষুধ প্রশাসনের শিথিলতা,

) ওষুধের মূল্য নির্ধারণে ফার্মেসী ইন্ডস্ট্রির প্রভাবের সুযোগ থাকাঃ ‘অধ্যাপক ডাঃ রশিদ ই মাহবুব বলেন,’এসেনশিয়াল ড্রাগের বাইরে যে ওষুধ রয়েছে সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে ওষুধ কোম্পানীগুলো। আর তারা সেটা করে থাকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সংগে যুক্ত হয়ে। এই মূল্য নির্ধারণ করার সময়ে ফার্মেসী ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা সেখানে থাকেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যকোনো দেশে ফার্মেসী ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা ওষুধের মূল্য নির্ধারণের সময় উপস্থিত থাকেন না (সোনালী নিউজ, ১৯১২১৬)’

)স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্লিপ্ততাঃ

) ওষুধ কোম্পানীগুলোর চতুরতা ঃ ‘কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলে সংশোধিত ব্লকলিস্ট দেখিয়ে ওষুধের দাম পুনরায় নির্ধারণের জন্য আবেদন করে কোম্পানীগুলো। কিন্তু কাঁচামালের দাম কমে গেলে ওষুধের দাম কমিয়ে পুনরায় নির্ধারণ করা হয় না। ওষুধের দাম নির্ধারণের জন্য স্বাস্থ্য সচিবের সভাপতিত্বে ১৬ সদস্যের ‘ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটি’ রয়েছে (একুশে পত্রিকা,২৬০৩২২)’

) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভ্রান্ত প্রজ্ঞাপনঃ

১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারী করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বলা হয়, এসেনশিয়াল ড্রাগ ছাড়া বাকী সব ওষুধের দাম নির্ধারণ করবে প্রস্তুতকারী কোম্পানী। আর তারাই সবকিছু ঠিক করে দিয়ে কেবল ভ্যাট দেয়ার জন্য ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন নেবে ‘সোনালী নিউজ, ১৯১২১৬)’

) ওষুধ কোম্পানীর কৌশলগত স্বেচ্ছাচারিতাঃ

) কাঁচামালের মূল্য কমলেও জ্বালানীসহ অন্যন্য খরচ বাড়ায় ওষুধের দাম কমানো হয় না,

)ওষুধের অযৌক্তিক মিশ্রন দেখিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেয়াঃ

আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাবে ওষুধের অযৌক্তিক মিশ্রণ দেখিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেয়া।

) দোহা ঘোষণার আলোকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অনেক সুবিধা পেলেও ওষুধের দাম কমানো হয়নিঃ দোহা ঘোষণার আলোকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প যে সুবিধাসমূহ পাচ্ছেঃ

. বাংলাােদশের কোন কোম্পানীকে ওষুধের পেটেন্ট এর জন্য মোটা খরচ করতে হয় না

. কাঁচামালও আমদানী করা হয় সস্তা দরের

. শুল্ক ভ্যাটে সরকারী ছাড় মেলে

. সামান্য কাঁচামাল দিয়ে বিপুল পরিমানে ওষুধ তৈরীর সুযোগ

. সস্তা শ্রমিক কর্মচারী ও উৎপাদন খরচ কম

. প্যাকেজিং পরিবহন খরচও কম

) ওষুধ কোম্পানীর বিপননের বাণিজ্যিক কৌশলঃ

. কোম্পানীসমূহের বিপনন ব্যয় বেশী হওয়াঃ

. মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের পেছনে ব্যয় বেশী হওয়াঃ ‘জুন ২১ এ প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা নামে সরকারি প্রকাশনার এক নিবন্ধে জরিপের ফলাফলে বলা হয়, ওষুধ কোম্পানীগুলোতে নিয়োজিত কর্মীদের মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ ৪৬ শতাংশ, বিক্রয় প্রতিনিধি ১৯ শতাংশ, উৎপাদন সংশ্লিষ্ট অকারিগরী কর্মী ১৭ শতাংশ, কারিগরী কর্মী ৬ শতাংশ, প্রশাসনিক ৫ শতাংশ, ফার্মাসিস্ট ৪ শতাংশ, কেমিষ্ট ২ শতাংশ, বায়োকেমিষ্ট ১ শতাংশ, অন্যান্য গাড়ীচালক, অফিস সহকারী, গার্ড ১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে বিপনন খাতেই সবচেয়ে বেশী খরচ (ফক্স থ্রি ডট কম, ত্রিশে মার্চ, ২২)’

. কাম্পানীসমূহের বিপননের বিভিন্ন ধাপে অত্যধিক ব্যয়

. ২০১৯ সালে প্রকাশিত ইবিএল সিকিউরিটিজের একটি গবেষণায় বলা হয়, ২০১৮ সালে বিপনন খাতে স্কয়ার খরচ করেছে ৯৯৬ মিলিয়ন টাকা, বেঙ্মিকো ৪২৮ মিলিয়ন, রেনেটা ৩৩৮ মিলিয়ন, একমি ১৬৪ মিলিয়ন, () ‘সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে ওষুধ কোম্পানীগুলো তাদের মোট টার্নওভারের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ব্যয় করে বিপনন খাতে (ফঙ থ্রি ডট কম, ত্রিশে মার্চ, ২২)’

. বিপননের কৌশল হিসাবে ডাক্তার রীচকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া যার কারণে বিশাল বহরের মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের উচ্চ বেতনে নিয়োগ দিতে হয়ঃ ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার গবেষণায় বলা হয়, একটি নতুন ফার্মাসিউটিকেল পণ্যের ক্ষেত্রে গৃহীত বিজ্ঞাপন কৌশলসমূহে অন্তভূর্’ক্ত থাকে চিকিৎসকদেরকে নতুন প্রবর্তিত ওষুধের উপকারীতা বিষয়ে সরাসরিভাবে অবহিত করা ৯২ শতাংশ, ফার্মেসীর যোগাযোগ ৪৬ শতাংশ, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সংগে যোগাযোগ ২৭ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে ৯২ শতাংশ ওষুধ কোম্পানী ওষুধের প্রচারের জন্য চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ রাখে (ফক্স থ্রি ডট কম. ত্রিশে মার্চ, ২২)’

.বিপননের কৌশল হিসাবে বৈজ্ঞানিক প্রচারণার চেয়েও বাণিজ্যিক প্ররোচণাকেই ওষুধ কোম্পানীসমূহের বেছে নেয়াঃ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী অনুষদের ক্লিনিকেল ফার্মেসী ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনিরউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশে ওষুধের বিপননে ওষুধ কোম্পানীগুলোর খরচ দিন দিন বাড়ছে এবং ওষুধের দামও সেই হারে বাড়ছে। আইনতঃ ওষুধ কোম্পানীগুলো পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে পারে না (ফক্স থ্রি ডট কম. ত্রিশে মার্চ,২২)’

উপসংহারঃ আলোচনার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, মূলতঃ সরকার ও ওষুধ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং ওষুধ কোম্পানীসমূহের বাণিজ্যিক কৌশলগত ব্যয়বহুল বিপননের কারণেই ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতএব এর প্রতিবিধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ কাম্য।

লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় ফুটবল খেলতে গিয়ে আহত তরুণের মৃত্যু