ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৪ জুন, ২০২২ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আমলা ছাড়া রাষ্ট্র চলবে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে আমলারা রাষ্ট্রীয় কার্য বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ইদানীং বিভিন্ন আন্তঃ বিভাগীয় বিরোধ, জনগণরাজনীতিবিদ ও আমলা এই তিন মুখী বিরোধ গণমাধ্যম এর সুবাদে প্রকট হয়ে উঠছে। আমলাতন্ত্রের অবস্থা বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই সন্তোষজনক নয়। এই অসন্তোষের মধ্যে তেলে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে সমপ্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। সমীর মীরওয়ার এবং তার পত্নী রিঙ্কু ধুগঘা কুকুর নিয়ে হাঁটার জন্য রাজধানী দিল্লির থায়াগ্রাজ স্টেডিয়ামে এ ক্রীড়াবিদদের অনুশীলন কয়েকঘণ্টা আগে বন্ধ করে দেয়। সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রচারিত হলে স্বামী আইএএস অফিসারকে শাস্তি হিসেবে লাদাখে (তিব্বতের সীমান্তে) ও স্ত্রী রিঙ্কুকে অরুণাচলের দুর্গম অঞ্চলে বদলী করা হয়। ভারত বড় দেশ। অনেক সমস্যা অনেকের পছন্দ হবে না। কিন্তু ন্যূনতম কিছু নীতি সে দেশে এখনো বর্তমান। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। কোনো বিভাগে দুএকজন সৎ অফিসার থাকলেই হয়। তারা রাষ্ট্রের ও সমাজের স্বার্থকে রক্ষা করে চলে। আমলাতন্ত্রের স্থবিরতার আরেক উদাহরণ কমিউনিস্ট রাশিয়া, ব্রেজনেভ এর আমলে পুরা ইউরোপে একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল রুশ ভাষায় যার নাম ছিল ‘ছাকো অথ ভেলোর’ বাংলায় বললে উলের কোট। এক পিয়ন বড় কর্তার অফিসের বাইরে কোট গায়ে ডিউটি করত। তার দরজার উপরে একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল। বার বছর এই ঘড়ি অচল ছিল। কিন্তু পিয়ন, বড় কর্তা কারো ঘড়ির দিকে নজর পড়েনি। এই নাটকটা ছিল একটি ব্যঙ্গাত্মক বা স্যাটায়ার নাটক। এখানে প্রশাসন যন্ত্রের নমুনা দেওয়া হয়।

ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্রের প্রথম প্রবক্তা জার্মান সমাজবিদ ম্যাক্স ওয়েবার। বুরো অর্থ ‘ডেক্স’ ক্রেসি অর্থ শাসন। ১৭ শতাব্দীর ফরাসি অর্থনীতিবিদ জেকুইস আমলাতন্ত্রের ঠাট্টা করে ডেস্ক তন্ত্র বলতেন। এবং দেশ শাসনে অন্য কোনো মেকানিজম এর কথা বলতেন। শিল্প বিপ্লবের সময়ে আমলাদের ক্ষমতা সুদৃঢ় হয়। তখন অনেক দার্শনিক আমলাতন্ত্রের দোষ ত্রুটিগুলো নিয়ে সরব হন। ১৮১৮ সালে লর্ড হিউয়ার্ট ঘব New DIscourse গ্রন্থে আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করে একে অপব্যয়, দুর্নীতিতে ভারাক্রান্ত একটি সিস্টেম বলে উল্লেখ করেছেন। হেগেল ও কাল মার্কস তৎকালীন ধনবাদী সমাজে আমলাতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। হেগেল সমাজের প্রাধান্য বিস্তারকারী শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করে যাওয়ার একটি রাষ্ট্রযন্ত্র বলেছেন আমলাতন্ত্রকে। তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সমাজের স্বার্থ ও প্রয়োজন। আমলাদের পাড়া অবহেলিত হয়। কাল মার্কস আমলাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় বিভাগ বলেছেন। কিন্তু আম রাষ্ট্র কার্য পরিচালনায় পেশা ও ডিগ্রিধারী ব্যক্তি থেকেও পেশায় স্বার্থ রক্ষাকারী প্রশাসনের উপর জোর দেন।

আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ওরা সরকারের পরিবর্তনের পরও প্রশাসনের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যায়। আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও রাজনীতিবিদদের মাঝে চেক ও ব্যালান্স না থাকায় আমলারা একটা অভিজাত শ্রেণীর রূপে সরকার চালায়। ফলে ঐ সব দেশে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দেয়।

রামসে মুর হ্যারল্ড লাস্কি ও বাট্রেন্ড রাসেল ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন। এসব মনীষী ২০০ বছরের ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের অভিজ্ঞতায় যেসব মন্তব্য লিখে গেছেন দুর্ভাগ্যক্রমে এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তা প্রাসঙ্গিক।

হ্যারল্ড লাস্কির মতে আমলাতন্ত্র হচ্ছে এবং অনেক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যাতে ক্ষমতার অধিকারী কেবল অফিসিয়ালরা। তাদের ক্ষমতা লাস্কির ভাষায় Jeopardises the liberty of ordinary citigens the অর্থাৎ কর্মকর্তাদের এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সাধারণ নাগরিকদের স্বাধীনতাকেই খর্ব করে।

রামসে মুর এর ভাষায় Under the cloke of democracy Bureaucracy thrives it devours the devours creator অর্থাৎ গণতন্ত্রের মধ্যে আমলাতন্ত্র দৈত্যের রূপ ধারণ করে পরিশেষে তারা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রকেই (স্রষ্টাকে) খেয়ে ফেলে। বাট্রেন্ড রাসেল এর মতে আমলাতন্ত্র নেতিবাচক মানসিকতাই ভুগে, সংস্কার বা পরিবর্তন মেনে নিতে নারাজ। বিগত শতকের আমলাতন্ত্রের ত্রুটিগুলো না কমে বরং আরো সংহত হয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটার বিশদ আলােচনা আছে। কিন্তু আমরা শুধু হেডলাইন গুলো উল্লেখ করব। () রক্ষণশীলতার ধারক ও বাহক () পরিবর্তন বিমুখতা () গতানুগতিক রুটিনে কাজ করতে অভ্যস্ত। () রুটিন এর বাইরে কাজ না করার প্রবণতা নিষ্প্রাণ ও যান্ত্রিক প্রশাসনের সূচনা করে। () কাজের দীর্ঘসূত্রতা () বিভাগীয় সংকীর্ণতা () পিরামিডের মতো বিভিন্ন স্তর কাঠামোর ফলে উপরের আর নিচের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার ভাব () এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর দায় চাপানো () রাষ্ট্রের অনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে জোর দিতে গিয়ে আদর্শগত লক্ষ্য ব্যাহত হয়।

আমলাতন্ত্র অপরিহার্য রাষ্ট্র পরিচালনায়, কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ আরো অপরিহার্য। আমলাতন্ত্রের সংস্কার কাজ করেছিলেন দু’জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। একজন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, অন্যজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। এই দুইজন গতানুগতিক আমলাদের উপরে পুঁজিবাদী চিফ এক্সিকিউটিভদের স্থান দিতেন তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। আমাদের দেশে পত্রপত্রিকায় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের স্যালুট না দেওয়া থেকে শুরু করে বিমান দেরি করা সবকিছুই হয় এলিট শ্রেণীদের দ্বারা। বর্তমানে ক্ষমতার কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণ এই ত্রিমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত স্বদেশ। কারো কোনো ক্ষতি নেই, যাঁতাকলে পড়ে শুধু কাতরায় জনগণ। মুক্তির উপায় কী? ব্রেইন ড্রেইন? মানি ট্রেইন?

অবশ্যই নয়। সমাজের বিবর্তন হয় ভালো মন্দের অভিজ্ঞতায়, নির্মোহ আলোচনা, ত্রিমুখী চেক এন্ড ব্যালেন্সই পারে রাষ্ট্র ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের মেলবন্ধন ঘটাতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্র-আলোয় শান্তিনিকেতন
পরবর্তী নিবন্ধসামনে নির্বাচন : হিসেব নিকেশের পালা