সামনে নির্বাচন : হিসেব নিকেশের পালা

শঙ্কর প্রসাদ দে | মঙ্গলবার , ১৪ জুন, ২০২২ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনেকটা দ্বারপ্রান্তে। স্বাভাবিকভাবে দেশের রাজনীতিতে নানামুখী তর্কবিতর্কের পারদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের খুঁজে নিতে হবে ভবিষ্যৎ দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে এমন রাজনৈতিক শক্তিকে। মৌলিক যেই বিষয়টি প্রাধান্য পাবে, সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং উন্নয়ন। এই মাপকাঠিতে বিচার করা যেতে পারে এদেশের প্রভাবশালী তিনটি রাজনৈতিক শক্তিকে।

এদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি মূলত ৩টি। ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানপন্থী বিএনপি এবং সুবিধাবাদী জাতীয় পার্টি। জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি এখন রংপুর আর সিলেটের আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। মূল্যবোধ অবক্ষয়ের জন্য এরশাদ যুগ যুগ ধরে অপরাধীর কাঠগড়ায় থাকবেন। নিজের মসনদ ঠিক রাখার জন্য দুরাচারী এই শাসক কেউ দাবী না করা সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রে যে আঘাত হেনেছে তা আমাদের প্রজন্মে অতিক্রম করা যাবে বলে মনে হয় না।

কয়েক দফায় বিএনপি দীর্ঘ ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। যারা পঁচাত্তর থেকে একাশি পর্যন্ত জিয়ার শাসনামল দেখেননি বা জন্মগ্রহণ করেননি, তারা বুঝবেন না কি দুঃসময় গেছে আমাদের উপর দিয়ে। জিয়ার স্ত্রীকে দেখলেই বুঝা যায় ইসলামী মূল্যবোধ তাঁর ব্যক্তি জীবনে কেমন। অথচ নিজ মসনদ এবং পরিবারতন্ত্র চিরস্থায়ী করার জন্য খামোকা ‘বিছমিল্লাহ’ জুড়ে দিয়েছিলেন সংবিধানে। নিষিদ্ধ করেছিলেন জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু আর ধর্ম নিরপেক্ষতাকে। শেখ পরিবারের বিপরীতে জিয়া পরিবার উত্থানের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি গঠনতন্ত্রে ইসলামী মূল্যবোধকে আদর্শিক ভিত্তি ধরলেন। দেশটিকে বানিয়েছিলেন পাকিস্তানী বাংলাদেশ।

৫ম সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বৈধ করার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা সঠিক কাজটিই করেছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিছক একটি জঙ্গী হামলা ছিল না। ডা. জাফরুল্লাহ বলছেন, বেগম জিয়া গ্রেনেড হামলার বিষয়টি জানতেন, তা তিনি বিশ্বাস করেন না। এই কথা শোনার পর থেকে জাফরুল্লাহর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। আমরা অনেকেই মনে করি বেগম জিয়া গ্রেনেড হামলার বিষয়টি পূর্বাহ্নে জ্ঞাত ছিলেন। তাঁর অনুমোদন ছাড়া এতো বড় ঘটনা ঘটেছে তা আমরা বিশ্বাস করি না। যদি তিনি কিছুই না জেনে থাকেন তবে জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ হতে দিলেন কেমনে এবং কোন যুক্তিতে। আসলে ব্যক্তি বেগম জিয়াকে ইতিহাস ক্ষমা করেনি।

এখন প্রশ্ন হলো প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার নিয়ে বিএনপি দেশটিকে আবার পাকিস্তানী বাংলাদেশ বানাতে চাইবে না তো? প্রথমত তারেক জিয়ার রাজনৈতিক মিত্র কারা? স্পষ্টত জামায়াত, হেফাজতে, মুসলিম লীগ, এল.ডি.পি জাতীয় দলগুলিই বিএনপি’র আদর্শিক মিত্র। একটা কথা খোলাখুলি বলা ভাল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া পর্বের আপাত সমাপ্তি ঘটেছে। তারেক জিয়া ব্যক্তি জীবনে কেতাদুরস্ত আধুনিক জীবন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। সমস্যা হলো ভদ্রলোক রাজনৈতিকভাবে বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের আদরে, প্রশ্রয়ে ও সংশ্রবে। পাকিস্তানী এই আদর্শই তাকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় উৎসাহিত করেছিল। ঘটনাটি মনে পড়লে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। যারা মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের পতন ঘটালে তারেক জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত। আসলে তারা দিবাস্বপ্ন দেখছেন।

মোদ্দা কথায়, স্বীকৃত বিষয় হলো শেখ হাসিনা চলমান তিন মেয়াদে মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতা নীতি প্রশ্নে কোনো আপোষ করেননি। হ্যাঁ, শাসনকার্য চালাতে গেলে ভুল ভ্রান্তি হতেই পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বহু ঘাটতি ছিল এবং এখনো আছে। সে সবের জন্য এককভাবে ব্যক্তি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করলে অন্যায় হয়। আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকে লুটপাটের চিন্তায় মগ্ন থেকেছি। পঙ্গপালের মতো ঝাপিয়ে পড়েছি আওয়ামী লীগের উপর, এম পি মন্ত্রীদের ঘাড়ের উপর। খাই খাই এই মনোভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায় ছিল। আমার মতে আমলাতন্ত্র যত দ্রুত ডিজিটালাইজ হবে ততই দুর্নীতি কমে আসবে। প্রশ্ন হলো, সামনের নির্বাচনে চলমান ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের পরিবর্তে জনগণ কি পাকিস্তানপন্থী শাসনব্যবস্থাকে স্বাগত জানাবে?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। ফ্রান্সে হাজার হাজার বাংলাদেশী মুসলিম যুবক অবৈধ পন্থায় ভিড় জমিয়েছে। মানবতাবাদী রাষ্ট্র ফ্রান্স এদের উদ্বাস্তু, রাজনৈতিক নিপীড়িত, ধর্মীয় নির্যাতিত হেতুতে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রক্রিয়ায় থাকতে দেয়। কিন্তু ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো গত দু’বছর ধরে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে হিজাবের বিরুদ্ধে। তার পরিষ্কার বক্তব্য হলো, যে মেয়েটি হিজাব পরবে, সে ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে রক্ষণশীল, উগ্রবাদী এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সে শত্রু ভাববে। কথায় ধারালো যুক্তি আছে বটে। সোজা কথায় ফ্রান্স ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রশ্নে কোনো আপোষ করতে রাজী নয়। আসন্ন নির্বাচনে একই প্রশ্ন উত্থাপিত হবে বাঙালি জনমানসে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কি চলমান ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিতে চলবে নাকি দ্বিজাতিতত্ত্বের জিয়ানীতিতে ফিরে যাবে? এটি আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর একটি মৌলিক প্রশ্ন। সত্তরের দশকে সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তানে বাঙালি থাকবে না। বাঙালি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। পাকিস্তানের মাথায় লাথি মেরে বাঙালি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাটির নীচে দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়েছে নিয়াজীর হাত দিয়ে। গত তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা দ্বিজাতিতত্ত্বের কবরে মাটির প্রলেপ দিয়ে ফেলেছেন। হ্যাঁ, আসন্ন নির্বাচনে দেখার বিষয় হলো বাংলার জনগণ কবর থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের লাশটি তুলবেন নাকি চিরস্থায়ীভাবে সিমেন্টের পাকা প্রলেপ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চিরসমাপ্তি টানবেন।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধদুর্ভোগ মুক্ত হচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ