রবীন্দ্র-আলোয় শান্তিনিকেতন

লিপি বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৪ জুন, ২০২২ at ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ

শহরের যান্ত্রিক কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে কবির প্রিয় শান্তিনিকেতন। ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে অতি প্রিয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আমার সুযোগ হয়েছিল পরিবার নিয়ে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করার। শালের ছায়াবীথি, বনপুলকের সুবাস, বাতাসে ঋতু পরিবর্তনের গন্ধ এখনো আছে। আর আছে বাঙালির ঝলমলে ঐতিহ্যের বিমুগ্ধ ইতিহাস।

আশ্রম গুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সারা জীবনের স্বপ্ন। বোধহয় এইখানে অনেকে পান প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। ১৮৬১ সালের ৭ মে, বাংলা ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম।

আজো মানুষকে সমানভাবে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। পুরো বিশ্ব রবীন্দ্র প্রেমে মন্ত্রমুগ্ধ।

কবিগুরুকে বিস্ময় পুরুষ বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটি মানুষের মনের কথা কি অবলীলায় লিখে গেছেন তার সৃষ্টির মধ্যে, প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ ফুটে উঠেছে তার গানে কবিতায়, গল্পে। কেমন অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী হলে এমন সৃষ্টি সম্ভব?

শান্তিনিকেতন প্রথমে প্রবেশ করে বেশ বিস্মিত হয়েছি। চোখ ভিজে উঠেছে প্রিয় কবির প্রকৃতির প্রতি এমন হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা দেখে। দুঃখ প্রকাশ করছিলাম কবির সময়ে কেন আমার জন্ম হলো না! শান্তি নিকেতন প্রবেশ করে প্রথমে চোখে পড়ে ছাতিমতলা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে যাওয়ার সময় এই ছাতিম তলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেছিলেন। এখানে তিনি তার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি পেয়েছিলেন। বর্তমানে এই ছাতিমতলা ঘেরা আছে। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

ছাতিমতলার ঠিক দক্ষিণ দিকের জায়গাটির নাম বকুলবীথি। এটি পাঠভবন এলাকার মধ্যে অবস্থিত। এখানে অসংখ্য বকুল ফুলের গাছ আছে। অজগ্র বকুল ফুল ঝরে পড়ে ভরে আছে মাঠ। তাই এই স্থানের নাম বকুলবীথি।

শান্তিনিকেতন বাড়ির সামনে রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ এর একটি শিল্পকীর্তি মূর্তিটির নাম অনির্বান শিখা। এই মূর্তিটিতে বোঝানো হয়েছে এক জননী শান্তিনিকেতনকে শিশুরূপে কোলে তুলে ঈশ্বরের নিকট তাঁর মঙ্গল কামনা করছেন।

উপাসনা গৃহ রয়েছে প্রবেশ দ্বারের বাম দিকে। সপ্তাহের প্রতি বুধবার সকালে উপাসনা হয়। যে কোনো সমপ্রদায়ের মানুষ এই উপাসনায় যোগ দিতে পারে।

উপাসনা মন্দিরের ঠিক উত্তর পূর্ব কোণে একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে একটি গোলাকৃতি খড়ের চালের বাড়ি আছে। এটিকেই তালধ্বজ বলা হয়। বর্তমানে এটি মহিলাদের কারু সংঘের কার্যালয়।

কাঁচ মন্দিরের পূর্বদিকে বিশাল বটগাছ ঘেরা জায়গাটির নাম তিন পাহাড়। পূর্বে এটি পুকুর ছিল। পরবর্তীতে পুকুর ভরাট করে বাগান তৈরি করা হয়। সূর্যোদয়ের সময় মহর্ষি এখানে বসে ধ্যানমগ্ন হতেন।

শান্তিনিকেতন বাড়ির দক্ষিণে আমগাছযুক্ত জায়গাটির নাম আম্রকুঞ্জ।

১৯১৩ সালে ১৩ নভেম্বর নোবেল পুরস্কার অর্জন করার পর বহু গুণীজন শান্তি নিকেতন এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই আম্রকুঞ্জেই আন্তরিক সংবর্ধনা ও সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসুকে এই আম্রকুঞ্জে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

আম্রকুঞ্জের ঠিক দক্ষিণ কোণে একটি ছোট বাড়ি আছে সেটির নাম দেহলী। রবীন্দ্রনাথ যখন স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে তখন এই বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর নাম অনুসারে এটি মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা নামে পরিচিত। মৃণালিনী বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের বাড়িটি মৃণালিনী ছাত্রী নিবাস। এটি এখন বিশ্বভারতীর স্নাতক মেয়েদের হোস্টেল।

মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা ও ছাত্রী নিবাসের মাঝখান দিয়ে কাঁকড় বিছানো একটি রাস্তা পশ্চিম দিকে গেছে। দুই দিকে তালগাছ ঘেরা রাস্তাটি শালবীথি নামে পরিচিত।

একটি ছোট কালো বাড়ি আছে। বাড়ির নাম চৈতি। মাটির দেওয়াল মাটির চাল। এই বাড়ির গঠন দেখে ধারণা করা যায় যে গ্রামে এইরকম বাড়ি তৈরি করলে হয়তো আগুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

চৈতি থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে ছাত্রী নিবাস।

প্রথমে জেনারেল কিচেন। একটু এগুলে পর পর ছাত্রী নিবাস শ্রীসদন, বিড়লা, গোয়েঙ্কা।

দশকের পর দশক ছাত্রীদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক মূল্যে মণ্ডিত আজকের শ্রীসদন।

এর পর আছে একটি স্নানরত মহিষ মূর্তির ভাস্কর্য। রামকিঙ্কর বেজের শিল্পকর্ম। গোয়েঙ্কা ছাত্রী নিবাসের সামনে নটিমূর্তি তৈরি করেন সুরেন দে মহাশয়। পেছনের দিকে বুদ্ধ মূর্তিটি তৈরি করেন রামকিঙ্কর বেজ। ছাত্রী আবাসনের সামনে চারিদিকে ঘেরা বিশাল মাঠটি বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। সংগীত ভবনটি দোতালা। এখানে একটি স্থায়ী মঞ্চ আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান এই মঞ্চে হয়ে থাকে। এরপর রয়েছে গুরুদেবের ছোট কন্যা মীরাদেবীর মালঞ্চ বাড়ি। এরপর আছে নাট্যঘর। এটি বিশ্বভারতীর সবচেয়ে বড় হলঘর।

ছাত্রী নিবাসের আড়ালে পড়ে যাওয়া আদি নন্দন ও নতুন করে তৈরি করা এখনকার নন্দন কলাভবনের বিভাগীয় গৃহ। ১৯৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর এই আর্ট গ্যালারি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উদ্বোধন করেন।

রবীন্দ্র মিউজিয়াম শান্তিনিকেতন দর্শকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। বুধবার বৃহস্পতিবার বাদ দিয়ে প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪:৪৫ পর্যন্ত খোলা থাকে মিউজিয়াম। প্রবেশ মূল্য সাধারণের জন্য ৫০ টাকা। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ১০ টাকা। বিদেশীদের জন্য ৩০০ টাকা।

মিউজিয়ামে কবিগুরুর বহু জিনিসপত্র রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনার ছবি ইত্যাদি বহু জিনিস গ্যালারিতে সাজানো আছে। বিশেষ আকর্ষণ নোবেল প্রাইজ। গুরুদেব গীতাঞ্জলি লিখে ১৯১৩ সালে যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন সেটি এখানে সংরিক্ষত আছে। বিচিত্রা ভবনের পাশে তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত গাড়িটি সযত্নে রাখা আছে।

একই জায়গায় পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে বাস করা গৃহসমূহ। সে অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে উত্তরায়ণ নাম দিয়ে। প্রথমে যে বাড়িটি আছে তার নাম বিচিত্রা। সেখানে রবীন্দ্র ভবন। আরো এগিয়ে গেলে বেশ বড় একটি অঙ্গন পশ্চিমের বাড়িটি উদয়ন। তারপর পশ্চিমে ও উত্তরে ঘুরে দেখবেন শ্যামল, কোণার্ক, পুনশ্চ, উদীচী।

শান্তিনিকেতন স্মৃতি বিজড়িত আরো কিছু বাড়ি যেমন : বেনুকুঞ্জ, দিনান্তিকা চাচক্র, সন্তোষালয়, চীনাভবন,হিন্দীভবন, দ্বিজবিরাম, পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় দপ্তর, রতনকুটি।

শান্তিনিকেতন উল্লেখ্যযোগ্য উৎসবগুলো হলকর্ষণ, শারদোৎসব, আনন্দবাজার, নন্দনমেলা, পৌষ উৎসব/ পৌষমেলা, বসন্তোৎসব, শ্রীনিকেতন বার্ষিক উৎসব ও মাঘ মেলা।

শান্তিনিকেতনে গান্ধীজীর আগমন ঘটে ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে। রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ গান্ধীজীর। রাজনীতি ও আশ্রমের নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। শান্তিনেকেতনে ১০ মার্চ সেই দিনটি এখনো পর্যন্ত গান্ধী পূর্ণ্যাহ নামে পালিত হয়।

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে আসেন। তারপর ১৯৩৯ সালে যখন শান্তিনিকেতন আসেন তখন তাঁকে আম্রকুঞ্জে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।

চালর্স ফিয়ার এন্ড্রুস ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন স্থায়ীভাবে এখানকার কাজে যোগ দিতে। তিনি ছিলেন গরীব দুঃখীর সেবক। তাই সকলে ভালোবেসে তাঁর নাম দিয়েছিলেন দীনবন্ধু। ১৯৪০ সালের ৫ এপ্রিল কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয় ৭০ বছর বয়সে।

এন্ড্রুস এর নামে শান্তিনিকেতনে একটি পল্লী হাসপাতাল রয়েছে।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু প্রথম ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন এন্ড্রুস সাহেবের সাথে দেখা করতে। কিন্তু কবির সঙ্গে তার দেখা হয়নি। পরে তিনি ১৯৩৪ সালে সস্ত্রীক আসেন শান্তিনিকেতন। কলকাতা থেকে গুরুদেবকে পত্র মারফত খবর পাঠান।

বিশাল সেই চিঠির কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি ‘We want to Santiniketan to pay a visit to the poet. It was always a joy to meet him and having come so near we did not wish to miss him. It was Kamala’s first visit and she had come specifically to see the place as we were thinking of sending our daughter there…

১৯৪৯ সালের ২ মে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ জওহরলাল নেহেরুকে বিশ্বভারতী আচার্য পদের জন্য নির্বাচিত করেন। এবং ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরিত হয়।

জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ১৯৩৪ সালে কলা বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্রী হয়ে ভর্তি হন। কিন্তু মাতৃ বিয়োগের জন্য তিনি বেশিদিন থাকতে পারেনি। ১৯৩৫ সালে তাঁকে এখান থেকে চলে যেতে হয়।

১৯১২ সালে কবি যখন বিলেতে তখন পিয়ারসন সাহেব কবির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি বেশ মুগ্ধ কবির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এ। শান্তিনিকেতনের কথা শুনে তিনি বালকের মতো পুলকিত হয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহ দেখে কবি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দেয়ার। ১৯১৪ সালে উইলিয়াম শান্তিনিকেতন কাজে যোগ দেন। ছেলেদের তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাদের অসুখে বিসুখে শয্যা পাশে বসে তিনি মায়ের মত সেবা শুশ্রূষা করতেন। রোগীদের প্রতি সেবা ও অক্লান্ত পরিশ্রম নিষ্ঠার কথা স্মরণ রাখতে শান্তিনিকেতন হাসপাতালের নতুন নামকরণ হয়েছে পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতাল।

১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকা ভ্রমণে যান তখন কবির সাথে লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট এর প্রথম সাক্ষাৎকারে হয় নিউইয়র্কে। কবি তাঁকে শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দেয়ার প্রস্তাব রাখেন। এলমহার্স্ট তৎক্ষণাৎ কবির আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ১৯২১ সালে নভেম্বর মাসে এলমহার্স্ট শান্তিনিকেতন এসে ১৯২২ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে সুরুল গ্রামে সংসার পাতলেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠাতা এবং এলমহার্স্ট তাঁর নির্মাতা।

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশ বিদেশের অসংখ্য মানুষ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শান্তিনিকেতন আসেন রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টি বিশ্বভারতী সম্পর্কে কিছু পরিচয় করার জন্য। কালজয়ী সৃজনশীলতার মাধ্যমে এখনো প্রিয় কবি রবি ঠাকুরের আলোয় আলোকির শান্তিনিকেতন। এই স্বল্প আলোচনায় এমন বিশাল ঐতিহ্যকে তুলে আনা সম্ভব নয়। তবু ও চেষ্টা করেছি ক্ষুদ্র আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা হলে ও শান্তিনিকেতনের উল্লেখ্যযোগ্য পরিচিতি তুলে ধরার। একবার হলেও ঘুরে আসুন রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন। (তথ্যঋণ : পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী)

লেখক : কবিগল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধযন্ত্রণায় কাঁদে ধরনীর বুক
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল