ভরাট চাক্তাই খালে যত শঙ্কা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৮ মে, ২০২১ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

চাক্তাই খালের কারণে খুব কষ্টে আছি। বছরের পর বছর ময়লা-আব্লর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। বর্তমানে খালের পচা দুর্গন্ধ পানিতে কিলবিল করছে মশার লার্ভা। বাসায় থাকতে পারি না মশার অত্যাচারে। বর্ষা চলে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে। তখন নতুন দুর্ভোগ শুরু হবে। অল্প বৃষ্টি হলেই বাসায় ঢুকে যাবে পাানি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে মিয়াখান নগরের বাসিন্দা এস এম হাসান আলী বলেন এসব কথা। চাক্তাই খালের পাড়েই তার বাসা। তাই ভয়টাও একটু বেশি। মশার কামড় সহ্য করলেও ঘনিয়ে আসা বর্ষায় সম্ভাব্য জলাবদ্ধতা নিয়েই বেশি ভীত তিনি। কারণ, বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলেও চাক্তাই খালের প্রায় পুরোটাই ভরাট হয়ে আছে।
হাসান আলীর মতো শহরের অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারাও এবার বেশ আতংকে আছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকার পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম চাক্তাই খাল। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, নগরের চকবাজার, দেওয়ান বাজার, জামালখান, স্টেডিয়াম এলাকা, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাই খাল গুরুত্বপূর্ণ। তাই এলাকাগুলোকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে প্রয়োজন চাক্তাই খাল পরিষ্কার রাখা। যদিও সরেজমিন গিয়ে খালটির প্রায় পুরোটাই ভরাট দেখা গেছে।
সাধারণত, শুষ্ক মৌসুম তথা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে খাল খননের উপযুক্ত সময়। অথচ এবার মে মাস চলে এলেও চাক্তাই খাল খনন কাজ শুরুই হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, এপ্রিল মাস থেকে ভারী বর্ষণ হয়। এবার প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়নি। তবে প্রকৃতির ওই বৈরিতা উল্টো আশীর্বাদ হয়েছে তাদের জন্য। কারণ, বৃষ্টি হলেই ভরাট হয়ে থাকা চাক্তাই খালের জন্য ভুগতে হবে তাদের। জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে ৫ হাজার ৬শ ১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় সিডিএর প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পটির আওতায় চাক্তাই খাল খনন করার কথা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাক্তাই খালের কারণে বর্ষায় কোনো সমস্যা হবে না। ভারী বৃষ্টি হওয়ার আগেই খাল পরিষ্কার করে পানি নিষ্কাশনের পথ করে দেবেন। এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, চাক্তাই খালের চারটি পয়েন্টে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ করছে সেনাবাহিনী। পয়েন্টগুলো হচ্ছে বহদ্দারহাট, চামড়ার গুদাম, দেওয়ান বাজার ও ফুলতলা। রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজের সুবিধার্থে সেখানে খালের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও এক পাশে পানি যাওয়ার জন্য সরু পথ রাখা হয়েছে। তবে সেখানেও প্রায় ভরাট হয়ে আছে। এছাড়া চাক্তাই খালের মুখে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় জলকপাট নির্মাণ করছে সিডিএ। সেখানেও বাঁধ দিয়ে খাল সরু করা হয়েছে। দ্রুত বাঁধগুলো অপসারণ করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করার দাবি করেছেন নগরবাসী।
এদিকে চাক্তাই খালের মিয়াখান নগর, বাদুরতলা, ফুলতলা, ঘাইস্যা পাড়া, ভাঙারপুল থেকে চালপট্টি, চালপট্টি থেকে মিয়াখান নগর ব্রিজ, মাস্টারপুল থেকে সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ, ধোনিরপুল থেকে ফুলতলা পর্যন্ত অংশও ভরাট দেখা গেছে। সেখানে বাসা-বাড়ির গৃহস্থালী বর্জ্য, ঝুট কাপড়, পলিথিন ও মাটির স্তূপ রয়েছে। খালের বিভিন্ন অংশে কচুরিপানা, বিভিন্ন গুল্মলতা, ঘাস উঠে গেছে। এমনকি কলাগাছও দেখা গেছে খালের মাঝখানে। কয়েক জায়গায় লোকজনকে হেঁটে খাল পার হতে দেখা গেছে। কোথাও আবার খালের উপর জমাট হওয়া ময়লার স্তূপে দৌড়ঝাঁপ করে খেলছিল ছোট ছোট ছেলেরা।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন আজাদীকে বলেন, পুরো খাল ভরাট। যত দ্রুত খাল পরিষ্কার হবে তত মঙ্গল হবে নগরবাসীর। বর্ষার তো বেশি দেরি নেই। এখনই খাল খনন করে পরিষ্কার করা না হলে তার মাশুল দিতে হবে ভবিষ্যতে।
১৭ নং পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলম আজাদীকে বলেন, রোজা শুরু হওয়ার আগে মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে সিডিএ চেয়ারম্যানের বৈঠক হয়েছিল। সেখানে মেগা প্রকল্পের পরিচালকও ছিলেন। সেখানে তারা বলেছিলেন, বর্ষার আগেই খাল খনন ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করবে। কিন্তু এখনো সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস, সর্বোচ্চ মার্চ পর্যন্ত হচ্ছে শুষ্ক মৌসুম। এ সময়ের মধ্যেই খাল পরিষ্কার করে ফেলা উচিত। কিন্তু এখন এপ্রিল শেষ হয়ে মে চলছে। তবু খাল পরিষ্কার হয়নি। বর্ষা তো দূরের কথা, খাল ক্লিয়ার না থাকায় অনেক নিচু এলাকায় মানুষের ব্যবহৃত পানিই তো যেতে পারছে না বর্তমানে। ঘর-বাড়িতে সেসব পানি ঢুকে যাচ্ছে। সেখানে স্থানীয় লোকজনের অবস্থা খুবই করুণ। যেখানে ব্যবহারের পানি যেতে পারছে না সেখানে বর্র্ষা শুরু হলে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হবে তখন।
তিনি বলেন, চাক্তাই খালের ফুলতলা এবং সাবএরিয়ার মুখে দুটি রিজার্ভার আছে। সেগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। অন্যান্য জায়গায় তো ভরাট হয়ে আছেই। বর্ষায় মানুষকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে হলে রাত-দিন স্কেভেটর দিয়ে খাল থেকে এখনই মাটি তুলতে হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী আজাদীকে বলেন, চাক্তাই খালের চারটি পয়েন্টে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করছি। সাড়ে ৫০০ মিটার নির্মাণ হয়ে গেছে। কাজের সুবিধার্থে সেখানে খালের মাঝখানে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সেজন্য এক পাশ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ আছে। তবে অপর পাশ দিয়ে পানি যাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে যে অংশ দিয়ে পানি যাচ্ছে সেটা আরো বড় করে দেব, যাতে পানি দ্রুত চলে যেতে পারে। চারটি পয়েন্টের বাইরে চাক্তাই খালের অন্য যেসব স্পটে ময়লা-আর্বজনা জমে গেছে সেগুলোও আমরা পরিষ্কার করে দেব। এক কথায় চাক্তাই খাল দিয়ে পানি যাওয়ার মতো পরিষ্কার করে রাখব। বর্ষাকালে চাক্তাই খালের জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
তিনি বলেন, বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, চাক্তাই খালে পানির লেবেল কম থাকলেও শহরে পানি জমে থাকত। এর কারণ ছিল, শহর থেকে পানি খালে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। তাই আমরা ড্রেন করেছি। পানি জমে থাকত এ রকম ২২টি স্পট চিহ্নিত করে কাজ করেছি। ফলে গতবার কিন্তু মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাটসহ চিহ্নিত স্পটগুলোতে পানি বেশিক্ষণ জমে ছিল না।
চাক্তাই খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণের কারণে মুখের প্রশস্ততা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে সিডিএ রেগুলেটর বসাচ্ছে। প্রকল্পটির পরিচালকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে, বৃষ্টি শুরু হলে একটি অংশ খুলে দেবেন। তাই সেখানেও পানি আটকাবে না।
প্রসঙ্গত, চাক্তাই খালের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৮ সালে পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ে চাক্তাই খাল খনন করা হয়। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দ্বিতীয় দফায় চাক্তাই খালের সংস্কার কাজ শুরু হয়। ওই সময় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয় ভূমি অধিগ্রহণ কাজে এবং তিন কোটি ৭৫ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা খালের দেয়াল নির্মাণ ও খনন কাজে ব্যয় হয়। পরে ২০০৩ সালে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তৃতীয় দফায় খালের তলা ও পাশ পাকা করা হয়। এরপর থেকে প্রতি অর্থবছরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে সিটি কর্পোরেশন খনন কাজ করত। ২০১৭ সালেও চসিক খনন করে। ২০১৮ সাল থেকে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে খালটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধবাস-টিকটিকি মুখোমুখি সংঘর্ষ নিহত ১