ব্যাঙের গান

রেজাউল করিম | বুধবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ব্যাঙ গান করে-শুনতে কেমন ঠেকায়। কিন্তু তারা গান করে, তবে বরষায়, রাত-বিরাতে। শহরে শোনা না গেলে গ্রাম বাংলায় ব্যাঙের ডাক চিরচেনা। ‘ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ/ কুনো ব্যাঙের ছা, খায়দায় গান গায়, তাইরে নাইরে না।’ ব্যাঙ নাকি গান করে? যারা এই গান শোনেনি তারা একটু অবাক তো হবেই। বরষা এলে খালবিল, নদীনালা পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। ডোবানালা ভরে যায় বর্ষার পানিতে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি রাতদিন চলতেই থাকে। আর সেই ডোবানালায় শুরু হয় নানা প্রজাতির ব্যাঙের উৎসব। তাদের ডাক শুনে শিশুরা বলে ওঠে প্যাক প্যাক, ওয়াক প্যাক!
শুনতে অবাক লাগলেও ব্যাঙের ঘর সংসার আছে। তারা মাটি খুঁড়ে বাসা বানায়। যাদের জ্বর-সর্দির ভয় নেই তারা পানিতে থাকে। অনেকে অট্টালিকা ভেবে গাছের ডালে বাসা বাঁধে। আর যারা অলস প্রকৃতির তারা ঝোপে-ঝাড়ে, উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ায়। বরষায় সমবেত ব্যাঙের ডাক এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করে, ডাকার সময় এদের গলার স্বচ্ছ চামড়ার থলি ফুলে ওঠে। সব প্রজাতির ব্যাঙ আবার ডাকতে পারে না। সব ব্যাঙই কিন্তু খেত-খামারের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উপকার করে। দুঃখের কথা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ঘন বর্ষায় সোনাব্যাঙের মজলিস এখন আর বসে না। সোনাব্যাঙ চলে যাচ্ছে বিদেশে। হয়তো বা কোনদিন আমরা শুনবো- সোনা ব্যাঙ লুপ্তপ্রায় এক প্রাণী।
‘নাক ড্যাঙা ড্যাং নাক ড্যাঙা ড্যাং নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং/ ছন্দ ছড়ার আসর বসায় ক্যাঙারু আর ব্যাঙ/ সেই আসরের নিয়ম হলো ঢ্যাম কুর কুর করে/ পড়তে হবে পদ্য-ছড়া নাকি সুরে সুরে/ প্রথম ছড়া পড়তে দাঁড়ায় ভূতের মাসি মেং/ পড়ছে জোরে-‘ঢ্যাঁম ঢ্যাঁমা ঢ্যাঁং ঢ্যাঁম ঢ্যাঁমা ঢ্যাঁং ঢ্যাঁং।’
ব্যাঙ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কতা দিতে পারে। ভূমিকম্প সতর্কতা, যা বিজ্ঞানীরাও এখনও আবিষ্কার করতে পারেননি। ইতালির এক গবেষক প্রফেসর গ্রান্ট। তিনি গবেষণার জন্য বেশকিছু কুনো ব্যাঙের গায়ে ঝুলিয়ে দেন বিশেষ সংকেতযুক্ত যন্ত্র। ভূমিকম্পের ৭ দিন আগে ব্যাঙগুলো অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। ভূমিকম্প শেষ হওয়ার ৬ দিন পর চিহ্নিত ব্যাঙগুলো পুনরায় গবেষণাস্থলে ফিরে এল এবং তার গবেষণা সফল হল। জানা গেল, এভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা সতর্কতা জানায়।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৪৯ প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়। তার মধ্যে কটকটি, কাঁকাড়াভুক, কুনো, কোলা, চামড়াঝোলা, জাকেরানাসহ নাম-না-জানা বৈচিত্রময় ব্যাঙের দেখা মেলে গ্রামগঞ্জে। ব্যাঙ সংরক্ষণের জন্য আবার দিবসও পালন করা হয়। এই ব্যাঙ আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। আমাদের রূপকথার আরেক অনুষঙ্গ ব্যাঙ। সাহিত্যের অনেকটা জুড়ে আছে ব্যাঙ। ‘শুনবে নাকি পুকুর পাড়ে/ আজ কি হলো, ঝোপঝাড়ে/ ব্যাঙের ছাতায় তিড়িং বিড়িং/ নাচ্ছিল এক ফোড়িং/ গাল ফুলিয়ে বলল ব্যাঙ/ ‘তুমি ভীষণ বোরিং’/ ব্যাঙের কথায় ভেংচি কেটে/ ফোড়িং গেল উড়ে/ তাই না দেখে কোলা ব্যাঙ/ জাম্প যে দিলো জোরে/
দুই ধরনের ব্যাঙ দেখা যায়। কুনোব্যাঙ আর সোনাব্যাঙ। এছাড়া পৃথিবীতে আরও ভিন্ন ধরনের ব্যাঙে দেখা যায়। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাতে রেইন ফরেস্ট বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে এক ধরনের ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায় যার নাম হল রেড-আইডট্রি ফ্রগ। ব্যাঙেরও রাজা আছে। যার নাম – গলিয়াথ ব্যাঙ। এরা বত্রিশ ইঞ্চি লম্বা, প্রায় তিন ফুট। এদের ওজন প্রায় আট পাউন্ড, এরা বাস করে আফ্রিকার ক্যামেরুন ও গিনিতে। একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া সাত মহাদেশেই ব্যাঙের দেখা মেলে। পৃথিবীতে প্রায় ৩৫০০ প্রজাতির ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষকেরা নতুন ধরনের, নতুন প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কার করেছেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের চিরহরিৎ অরণ্য, গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাঙ মুখের ভেতর বাঁকানো দুটি বিষদাঁত আছে এদের আর আছে কালো হুকের মতো একটা অংশ যা মুখের বাইরে বের হয়ে আছে। এরা গাছের কোটরে জমা জলে ডিম পাড়ে। সব ডিম থেকে আবার ব্যাঙাচি জন্মায় না। বিশ্বের ছোট ব্যাঙ হল -নাইট ফ্রগ। অ্যামাজনের জঙ্গলে দেখা মেলে নখের আকারের মতো ক্ষুদ্র ব্যাঙ। এরাও যখন-তখন এদের গায়ের রং বদল করতে পারে।
কিউবায় দেখা মেলে বিশ্বের সবথেয়ে বড় ব্যাঙ, এদের নাম – ‘নর্থ আমেরিকান বুল ফ্রগ’। বিজ্ঞানীরা এক দৈত্যাকার ব্যাঙের ফসিল বা জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন, এরাই হল সেই ব্যাঙ যারা ডাইনোসরের যুগে ডাইনোসরের বাচ্চাদের টপটপ করে গিলে খেতো অর্থাৎ এরা হলো ‘ডাইনোসর গেলা’। এই ব্যাঙ প্রায় সাত কোটি বছর আগের। এই ব্যাঙ পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতো। ব্যাঙ আমাদের পরিবেশ রক্ষায় উপকারী প্রাণী। বৈদেশিক মুদ্রার লোভে গণহারে ব্যাঙ নিধন উচিত নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যবিধি
পরবর্তী নিবন্ধইউসেপের মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান