বৃহৎ বাণিজ্য জোট : বাইরে থাকায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা

| মঙ্গলবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

চীনের নেতৃত্বে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যে বাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু হল, তার বাইরে থাকায় রপ্তানি বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতি গবেষকরা। ২০২৪ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাত্রা শুরু করলে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলেই তাদের মত। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জটা হবে, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে, তখন এসব দেশগুলোতে বিশেষত জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য যে মার্কেট অ্যাঙেস আছে, যেগুলোতে আমরা এখন শূন্য শুল্ক সুবিধা পাচ্ছি, সেগুলোতে আমরা ২০২৪ এর পরে পাব না। কিন্তু আমাদের যেসব প্রতিযোগী দেশ আছে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম, তারা চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে শূন্য শুল্ক সুবিধা পাবে। যেহেতু তারা আরসিইপির মেম্বার হতে যাচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।
চীনের উদ্যোগে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশ নিয়ে গত রোববার গঠিত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য জোট, আগামী দিনের বিশ্ব বাণিজ্যে যার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিন ‘রিজিওনাল কমিপ্রহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)’ নামে নতুন এই জোট গঠনের চুক্তি হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের ১০ দেশের সঙ্গে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই জোটে থাকছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু এই চুক্তির মধ্যে নাই, সেহেতু বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার জায়গা আছে। বিশেষ করে চীনে বাংলাদেশ বাণিজ্য সুবিধা পায় প্রায় ৯৭ ভাগ পণ্যে, সেখানে কিন্তু ভিয়েতনাম খুব সহজে ঢুকতে পারবে। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের ৫ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কলাম
অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু চীনে না, অস্ট্রেলিয়া, জাপান কোরিয়াতেও বাংলাদেশ জিএসপির অধীনে সুবিধা পায়। সেটাও কিন্তু ভিয়েতনামসহ অন্যান্য আসিয়ান দেশ প্রতিযোগিতায় যাবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীনের প্রভাব খর্ব করতে বারাক ওবামার সময়ে ১২ দেশের ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ (টিপিপি) চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনেন। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প জমানার অবসানের সময় আরসিইপি চুক্তি ওবামার সেই জোটের জন্যও বড় ধাক্কা হয়ে এল এবং চীনের অর্থনৈতিক উচ্চাশা পূরণের পথকে আরও মজবুত করল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিবিসি বলছে, নতুন এই জোটের আওতায় পড়বে বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে যে মুক্ত বাণিজ্য এলাকা তৈরি হবে, তা আকারে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেঙিকো নিয়ে গঠিত মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও বড় হবে। এশিয়ার আরেক বড় অর্থনীতির দেশ ভারতেরও এই চুক্তিতে আসার কথা ছিল। কিন্তু সস্তা চীনা পণ্যে বাজার ভরে যাওয়ার আশঙ্কায় নরেন্দ্র মোদীর দেশ গত বছর এ আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়। এরপরও নয়াদিল্লির জন্য দরজা খোলা থাকছে বলে রোববার আসিয়ান দেশগুলোর নেতারা মন্তব্য করেছেন।
আসিয়ানভুক্ত দেশ হওয়ার সুবাধে এই বড় বাণিজ্য জোটে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় খাত তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরেই তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাপিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। কেবল বাণিজ্য নয়, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের দিক বিবেচনায়ও প্রতিযোগী দেশগুলো আরসিইপির কারণে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজ বলেন, বিনিয়োগের দিক থেকেও যারা বিনিয়োগ করতে আসবে, তারা আসিয়ানের এই বড় মার্কেটে বিনিয়োগ করলে তারা আরসিইপির পুরো বাজারটাতে সুবিধা পাবে, শূন্য শুল্ক দিয়ে ঢুকতে পারবে। মার্কিন কোনো বিনিয়োগ যদি এখন মিয়ানমারে করে, তাহলে সে এ বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনের বাজারে ঢুকবে শূন্য শুল্ক সুবিধা নিয়ে। বিনিয়োগের আকর্ষক হিসাবেও বাংলাদেশের দিকে আগ্রহটা কমে যাবে। চীন, জাপান, কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও জোটের ভেতরে থাকা দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেবে মন্তব্য করে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, নিজেদের ভেতরে কিন্তু অগ্রাধিকার দেবে। যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমাদের যথেষ্ট রকম আগ্রহ এবং সামনের দিনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কিন্তু একটা বাড়তি চাপ আসতে পারে, কারণ তারা নিজেদের মধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
করণীয় কী : বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য জোটের বাইরে থাকার ধাক্কা সামলে কাটাতে বাণিজ্য কৌশল ঠিক করে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। এক্ষেত্রে বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) আলোচনা চলছে, সেটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির করার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ তাদের। এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিমসটেকের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই হতে যাচ্ছে, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া, সেটার মাধ্যমে আমরা যাতে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বাজারে ঢুকতে পারি, এটা হল স্বল্পকালীন চিন্তা। মধ্যবর্তী পরিকল্পনার বিমসটেকের এফটিএর সঙ্গে আসিয়ান বা বৃহত্তর আরসিইপর দ্বিপাক্ষিক কিছু করা যায় কি না, সেটা চিন্তা করা যেতে পারে। আরসিইপির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী খাতে স্টান্ডার্ড বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মোস্তাফিজ বলেন, শ্রম, কপিরাইট স্টান্ডার্ড, আইপিআর, ই-কমার্স ও পেটেন্ট আইন প্রভৃতির স্টান্ডার্ড ’যথেষ্ট উন্নত’ করতে হবে। আবার আমাদেরকে কিছু ছাড় দিতে হবে। আমরা শূন্য শুল্কে ঢুকতে চাইব, তারাও তো আমাদের এখানে ঢুকতে চাইবে। সেগুলোর জন্য প্রস্তুতির দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন বেরিয়ে গেলেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন সরকার আবার টিপিপিতে ফিরতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। টিপিপিতে যুক্তরাষ্ট্র ফিরলে সেখানেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে ভিয়েতনামের মতো দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও ভিয়েতনামের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকার কথা তুলে ধরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা তার মেয়াদ আছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। ২০২৭ সালের পর যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে আমরা ইউরোপের বাজারে ১২% ডিউটি দিয়ে ঢুকব, তখন ভিয়েতনাম শূন্য শতাংশ ডিউটি দিয়ে ঢুকবে। আসিয়ানসহ আরসিইপির অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, এখন বাংলাদেশের সুযোগ আছে নিজে সক্রিয়ভাবে থেকে আগ্রহটা দেখানো যে, আমি এখানে অংশগ্রহণ করতে চাই। কিন্তু প্রথমে অংশগ্রহণ করাটা সোজা হবে না, কারণ বাংলাদেশের তো কোনো দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি নাই। বাংলাদেশের প্রাথমিকভাবে আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, সেটার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। আমাদের যেটা হয়, আমরা কোনো একটা কিছু হওয়ার পর রিঅ্যাক্টিভ হই, প্রোঅ্যাক্টিভ না। প্রোঅ্যাক্টিভ হওয়াটা এখন খুব জরুরি, বলেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্রিটিশ হাই কমিশনারের সম্মানে নৈশভোজ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬