স্বাধীন বাংলাদেশের পথ চলায় এ বছরটি নানা কারণে মাইল ফলক হয়ে থাকবে। এ বছরটি আমাদের কাছে ব্যাপক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মের শততমবর্ষ পূরণ করে নতুন শতকে যুক্ত হল এ বছরের ১৭ মার্চ। ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্ণ হয়েছে। বছরব্যাপী সারাদেশে পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুদৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে দরিদ্র দেশ হতে নিম্ম মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত হতে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর এ বছরটিতে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সমস্ত শর্ত পূরণ করে জাতিসংঘের কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের গৌরব অর্জনের ৫০বছর পূর্তিতে লাল সবুজের উৎসবে মেতেছে বাংলাদেশ। বহু গৌরব অর্জনের এ শুভ মূহুর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, জাতির পিতার আদর্শ ও জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মেয়র হিসেবে চট্টগ্রামের অধিবাসীসহ সমগ্র বাঙালি জাতির প্রতি জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও হৃদয়-উৎসারিত অভিনন্দন। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেরই জাতীয় দিবস রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সেই বিজয়ের মূহুর্ত বা বিজয় দিবস সকল দেশ ও জাতির নেই। আমরা সেই গর্বিত বাঙালি যাদের এই বিরল গৌরবের দিন রয়েছে, বিজয় দিবস রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ভাষাভাষির জন্য একটি দেশ, এটিও পৃথিবীতে বিরল। আমরা বাংলা ভাষাভাষির জন্য নিজস্ব একটি ভূখণ্ড, নিজস্ব একটি দেশ বাংলাদেশ। এ দেশ কারো দানে পাওয়া নয়। এ প্রাপ্তির পিছনে রয়েছে অনেক রক্তঝরা সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ হতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিতারণের পর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের মধ্যখানের বিশাল ভূখণ্ড রেখে পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে নিয়ে পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার কিছুদিন পর হতেই বাঙালি বুঝতে পারে তাদেরকে কমজোর কিংবা নিশ্চিহ্ন করে দিতে ছক কেটেছে পশ্চিমারা। ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার। মুহূর্তেই বাংলার ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদ জানায় এবং ক্রমে এ প্রতিবাদ সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ নেয়। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার এ আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ অকুতোভয় ভাষা শহীদ ভাইয়েরা। এতে করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের আদি হতে অন্তে স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনন্য নেতৃত্বের ভূমিকা রাখেন।
১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এতে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তার হৃদয়ে লালিত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের বীজ সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়ের গভীরে পুতে দিতে কাজ শুরু করে দেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে মহাস্ফূরণ ঘটিয়েছিলেন, তার উপর ভর করেই আসে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন বাংলাদেশ। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ। ৬৯ এর উত্তাল গণ অভ্যূত্থানের পথ বেয়ে আসে ৭০ এর নির্বাচন। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জনগণের মেন্ডেট লাভ করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ, আসে একাত্তর।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশন প্রদান করেন। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তানী বর্বরতা ও গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে নিজ বাসায় পাকবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং টেলিগ্রাফের মাধ্যমে এ ঘোষণা পত্র চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর নিজস্ব বাসভবন ফিরিঙ্গী বাজারের জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে টাইপ করে চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে বিতরণ ও মাইকে ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয় এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঐদিনই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন। দীর্ঘ ৯ মাস প্রাণপণ লড়াই, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ মা-বোনের হারানো সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বাঙালি বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে আনে গৗরবদীপ্ত বিজয়।
স্বাধীনতাত্তোর কালে জাতির পিতা বলেছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। স্বাধীনতার শত্রু, একাত্তরে পরাজিত শক্তির হীন ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে বঙ্গবন্ধুর এ উক্তির যথার্থতা টের পায় জাতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ক্ষমতার মসনদে বসে বেনিফিসিয়ারী গোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর আঘাত হানে। ইতিহাস বিকৃত করে বাঙালিত্বকে আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলণ্ঠিত করার সকল প্রকার হীন কর্মকাণ্ড চালায় তারা। দেশের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলার আয়োজন সম্পন্ন করে পাকিস্তানী ভাবধারার নতুন বাংলাদেশ গড়ার অপপ্রয়াস চালায় তারা। এতে তারা সফল হতে পারেনি, বাঙালি চেতনায় বার বার আঘাত করেও চিড় ধরাতে পারে নি। বাঙালি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমৃদ্ধ হয়েছে। জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘন অন্ধকারের বুক চিরে দীর্ঘ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার হাতেই তুলে দিতে সক্ষম হয়। তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে। সে দিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার ছাড়িয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমান হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করবে-এই শুভ প্রত্যাশায় সকলকে আবারো জানাই গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ ও মেয়র,
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।