বাঁচার পথটুকু অন্তত মানুষ জানুক

রিতু পারভী | শনিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বিপন্ন পৃথিবী, বিপন্ন এর প্রাণ-প্রতিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন যাত্রায় অসহায় ধরিত্রীর সার্বজনীন পরিবেশ। কোটি কোটি গাছ লাগিয়ে সবুজে ছেয়ে দেয়া ছাড়া তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়, সাথে জরুরি আরও অনেক সহায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। অথচ গাছ লাগানোর পরিবর্তে আমরা সমানে উজাড় করছি বনভূমির পর বনভূমি। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন ক্রমশ-ই শীর্ণ হয়ে আসছে। অবাধে চলছে বেআইনি বৃক্ষনিধন বিশ্বজুড়ে। আমরা নির্বিকার।

বোধহীন এই পৃথিবীতে এখনো জন্ম নেয় কিছু মানুষ যারা পথ দেখায়। এই উপমহাদেশেই অনেক মহৎ প্রাণ মানুষ গাছ বাঁচাতে, বন বাঁচাতে উদাহরণ তৈরি করে গেছে। বিমলা বহুগুণা আর তাঁর স্বামী সুন্দরলাল বহুগুণা এমনই মানুষ। বিমলার নেতৃত্বে গ্রামের অন্য মহিলারা কনট্রাকটরের করাল করাতের মুখে গাছ জড়িয়ে ধরে চিপকো শুরু করেছিলেন মাড়োরা গ্রামে। সাহসী বিমলা গাছ জড়িয়ে প্রকৃতি বাঁচানোর শত বছরের পুরোনো ইতিহাসকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। আরেকদল সাহসী নারী গাছ বাঁচানোর এই আন্দোলনে তাঁর পাশে দাঁড়ায়, পাশে দাঁড়ায় বিমলার স্বামী সুন্দরলালও।
চিপকো আন্দোলনের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। হিন্দি ‘চিপকো’ শব্দ হলো চেপে ধরা বা ছেড়ে না দেয়া। গাছের সাথে নিজেকে চেপে ধরে দুর্বৃত্তদের করাল করাতের হাত থেকে মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু গাছকে বাঁচানোর এক মহৎ আর সাহসী উদাহরণ এই আন্দোলন।
আসলে বিমলা বহুগুণার আগে প্রায় আড়াইশো বছর পূর্বে রাজস্থানের বিশনোই গ্রামের নারীরা, অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে গাছ জড়িয়ে ধরে তাদের রক্ষার আন্দোলন করেছিলেন। সেবার মারোয়াড়ের রাজার কুঠার খেজরি গাছের সঙ্গে ৩৬৩ জন নারী-পুরুষের শিরঃচ্ছেদ করেছিল। সেই ইতিহাস লোককাহিনির বহতা ধারায় পৌঁছে গিয়েছিল তেহরি গাড়োয়ালের প্রত্যন্ত গ্রামে।
হিমালয়ের বিপন্ন পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে আড়াই বছর ধরে সাত হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে হাজার হাজার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুন্দরলাল। তাদের বার্তা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন এমনকী দিল্লিতে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তাঁর আর্জি মেনে পাহাড়ে গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ইন্দিরা গান্ধি।
আমাদের এই দেশেই আছে ইদ্রিস আলীর মত মহৎপ্রাণ মানুষ। গাছ ভালোবেসে, গাছের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে যুগের পর যুগ ধরে তিনি গাছ লাগিয়েই গিয়েছেন। এই গাছ তিনি অর্থনৈতিক লাভের কথা ভেবে লাগাননি। দ্রুত বড় হবে কিংবা দামী কাঠ পাওয়া যাবে এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে তিনি গাছ লাগাননি, গাছ লাগিয়েছেন প্রকৃতি ভালবেসে, পৃথিবীকে বাঁচাতে। পাবনার ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী ইদ্রিস আলী তিন যুগে শুধু বট গাছই লাগিয়েছেন চার শতাধিক। এই বটগাছ থেকে তিনি কোন লাভের কথা চিন্তা করেছেন? না, অর্থনৈতিক লোভ তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি তাই প্রকৃতির অত্যন্ত জরুরী এই বটগাছ লাগিয়েই চলেছেন বছরের পর বছর। অন্যান্য গাছও লাগিয়েছেন হাজার হাজার।
এই আলোকিত মানুষেরা পথ দেখিয়েই চলেছেন। অথচ কর্পোরেট আগ্রাসনের শিকার সার্বিক ব্যবস্থা আমাদের সে পথ দেখতে বাঁধা দেয়। কলুষিত সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আলোর সমস্ত পথ আঁধারে মুড়ে রাখে। ছিঁড়ে যাক সমস্ত বাধা, বাঁচার পথটুকু অন্তত মানুষ দেখুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিবাসন অভিযাত্রার করুণ আর্তনাদ
পরবর্তী নিবন্ধবাংলার নাম গাই