বাংলার নাম গাই

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য শহরে স্বর্ণালী শৈশব কাটানো আমার মেয়ে ইউটিউবের কল্যাণে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো…’ কে কণ্ঠে ধারণ করতে শেখে। গানের গল্পটা মায়ের কাছে শুনে অদেখা সালাম-বরকত রফিক ভাই-দের জন্য চোখ ভেজায়। ইতোমধ্যে অ আ ক খ’র সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যায় ওর। একটু একটু করে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে। অতঃপর দশম বর্ষে পা দেবার আগে পাকাপাকিভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। চেনা পৃথিবী ছেড়েছুঁড়ে চলে আসায় বুক ভেঙে যায় মেয়ের। বাবা মায়ের উচ্চশিক্ষার অভিলাষ পূরণে মেয়ের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যায় তার রেশ আজও চলছে। তবে এখন আর ‘এসো হে বৈশাখ’, ‘ওমন রমজানের ঐ রোযার শেষে’, আর ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ শোনার জন্য ইউটিউবে খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। এতো কম পাওয়া নয়।
অনেক প্রতীক্ষার একুশের প্রহর। বাবা মায়ের সঙ্গে মেয়ে রওনা হয় স্কুলের পথে। বড় রাস্তায় সারিসারি পিকনিকের গাড়ি। চড়া শব্দে ভেসে আসছে হিন্দি নয়তো ইংরেজি গান। মেয়ের প্রশ্ন- ‘মা, তুমি বলেছিলে একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের দিন। তাহলে ওরা কেন আজ পিকনিকে যাচ্ছে?’ এ প্রশ্নের জবাব নেই। সরকারি ছুটির দিনে আনন্দ উদযাপনের এই সুযোগ হাতছাড়া করে শোকাভিভূত হয়ে দিনটা মাটি করার মতো বোকা আর নয় আমাদের বাঙালিরা। কত এগিয়ে গিয়েছি আমরা! সাফল্যের পালকেরা সব উড়ছে আকাশে বাতাসে।
স্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শুরু হয় সেদিনের আয়োজন। খুব মন দিয়ে মেয়ে দেখছে সব; বক্তৃতা, ভাষণ, নাচ, গান, নাটিকা…। আমি দেখছি আমার মেয়েকে। কয়েক ঘণ্টাব্যাপি চলে অনুষ্ঠান। বাড়ি ফেরার পথে প্রশ্ন আর প্রশ্ন- ‘শোক দিবসের কিছুইতো নেই মা, কেন? কারও মন খারাপ হয়নি কেন?। সবাই ‘ফেস্টিভ মুডে’; রঙিন কাপড়, রঙিন চুল- সবাই পহেলা বৈশাখের মতো করে সেজে এসেছে কেন?।
সত্যিই তো, একুশ নিয়ে আমাদের মনে আর শোকতাপ কাজ করে না। উৎসবের উন্মাদনায় মত্ত থাকা আমাদের মতো সুবিধাভোগী নাগরিক গোষ্ঠী একুশকে নিতান্তই ঈদ পার্বণের মতো একটা উৎসবের কাতারে স্থান দিয়ে ফেলেছে। বড়, ছোট যে পরিসরেই একুশের আয়োজন থাকুক, সবই হয় উৎসবের আদলে, উৎসবের আমেজে। রঙ মিলিয়ে পোশাক, সাজসজ্জা, দিন ভর নাচ গান… ভূরিভোজনও বাদ পড়ে না দিনের পরিক্রমা হতে। অতিমারি বলেও কোন কিছুতে কাটছাঁট হওয়ার নয়। কাগজে ‘সীমিত পরিসরে’ সেঁটে দিয়ে সীমাহীন আনন্দে ভেসে যাই আমরা, উন্মত্ত বঙ্গসন্তানেরা।
সেদিন বাড়ি ফিরে সোজা টেলিভিশনের সামনে। পর্দায় চলছে ‘জীবন থেকে নেয়া’। সাদা কালো ছায়াছবি মেয়ের মনে ধরবে কিনা, এই নিয়ে সংশয়ে আছি। কিন্তু মেয়ের চোখে পলক পড়ে না। জয়তু জহির রায়হান! বেঁচে থাকুন হাজার বছর ধরে। বিকেলে চলে ‘আলোর মিছিল’। এবারও মেয়ে সেঁটে আছে টিভি’র সামনে। কে বলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ছায়াছবি দেখতে চায় না? হ্যারি পটার, এভেঞ্জারস, হাঙ্গার গেমস- এর সংলাপ, দৃশ্যপট সব ওর মুখস্থ। তাই বলে পঞ্চাশ বছর আগে জহির রায়হান, নারায়ণ ঘোষ মিতাদের বানানো চলচ্চিত্র দেখতে কোন অনীহাইতো দেখায়নি।
বাংলা ছায়াছবি দেখে দেখে রাত হয়। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মেয়ের প্রস্তাব- ‘মা, এখন থেকে একুশে ফেব্রূয়ারিতে আর বাইরে গিয়ে কাজ নেই। আমরা বরং ঘরে বসেই আমাদের মতো করে দিনটা কাটিয়ে দিই’। মন্দ বলেনি। পরিপাটি পোশাকে স্থিরচিত্র কিংবা চলমান দৃশ্য ধারণের ভিড়ে আর হারিয়ে যেতে হবে না। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রতি ছাব্বিশে মার্চ, প্রতি ষোলই ডিসেম্বর- ঘুরেফিরে একই ছবি দেখানো হয় টেলিভিশনে। আগুনের পরশমণি, আমার বন্ধু রাশেদ, মাটির ময়না যুক্ত হয় ছায়াছবির তালিকায়। দেখা ছবিগুলোই আমরা মা-মেয়েতে মিলে আবার দেখি, বারবার দেখি। বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে আমাদের মতবিনিময় ও পারিবারিক আলোচনা সভা।
সাতটি বছর বিদেশ বিভূঁই করে দেশে ফিরে এসে মেয়েকে মূলধারার স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে বড় একটা হোঁচট খেতে হয়েছিল। অবশ্য আমার দেশে কোনটা আসলেই ‘মূলধারা’ সেটা নির্ণয় করার সাধ্য কারও আছে কি না জানা নেই। এত ধারা উপধারায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে যে কারও সঙ্গে কারও মেলবন্ধনের কোন সম্ভাবনা বোধ করি ইহজগতে নেই। এই শহরে একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই যেখানে মেয়েকে ভর্তি করিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। অতএব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করতে হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম চালু আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে শুরুতেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় মেয়েকে। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে আমার পরীক্ষার সঙ্গে অপরিচিত হওয়ায় অকৃতকার্য হয়ে যায়। স্কুলের অধ্যক্ষ সবিনয়ে আমাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে- ‘ও এমন প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ‘সারভাইভ’ করতে পারবে না, এখানেতো বছর জুড়ে পরীক্ষা লেগেই থাকে, খারাপ করলে হীনমন্যতায় ভুগবে’। বছরের তখন মাঝামাঝি। ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানই তখন আমাদের উদ্ধার করে, যদিও তার জন্য গুনতে হয় অনেক চড়া দাম।
আমার মেয়ের নতুন প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ভাল দিক এখানে প্রথম, দ্বিতীয় হওয়া নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ অযথা দৌড়ঝাঁপ করেন না। একজনের পক্ষে অন্যজনের পরীক্ষার ফলাফল দেখার সুযোগ নেই। ফলে তুলনামূলকভাবে কম নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীদেরকে কোনরকম হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়না। তবে চূড়ান্ত পরীক্ষায় যাতে ফলাফল বিপর্যয় না ঘটে সেজন্য বিদেশ ফেরত অনেকেই পাঠ্যবিষয়ের তালিকা হতে ‘বাংলা’ কে বাদ দিয়ে থাকেন। কারণ বাংলা কখনোই অর্থকরী বিষয় নয়। তাছাড়া জটিল আর দুর্বোধ্য ব্যাকরণ, বাগধারা, রচনা, পত্রলিখন … এসব শিখে জীবনে কি-ইবা হবে! বাংলা থেকে কেউ অব্যাহতি পেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ আবেদন মঞ্জুর করে দেন। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ আমাকে পরামর্শ দেন ‘কেন মেয়েটাকে এত কষ্ট দিচ্ছ? বাংলার কারণে ওর সামগ্রিক ফলাফলটাইতো খারাপ হয়ে যেতে পারে’। বাংলা থেকেই যদি নিষ্কৃতি চাইব তবে কেন বাংলাদেশে ফেরা? ‘বড় ভুল করেছো ফিরে এসে’- অভিজ্ঞ শুভানুধ্যায়ীদের স্বগতোক্তি।
কিন্তু না। শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র সঙ্গে গলা মিলিয়ে মেয়ে যখন ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল…’ গায় গুনগুনিয়ে, তখন মনে হয় ভুল করিনি। ‘একটি কথা আমি শুধু বলে যেতে চাই, বাংলা আমার আমি যে তার আর তো চাওয়া নাই রে…’ বলে মেয়ে যখন গলা ছাড়ে তখন সত্যিই মনে হয় ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে…’। তবে স্কুল প্রাঙ্গণে মেয়ের ছুটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার সময়টায় নিজেকে ভিনদেশি বলেই মনে হয়। ফুলের মতো শিশুকিশোরের দল এ কোন ভাষায় কথা বলছে! না ইংরেজি, না হিন্দি, বাংলা হলেও তা বিকৃত। কোন কারণে বিরক্ত হলে ‘ধ্যাত’ বা ‘ধ্যাত্তেরিকা’ বলি আমরা। আমাদের সন্তানেরা এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়। ওরা কখনও ংযৃঃ, আবার কখনওবা ভ..শ উচ্চারণ করে অবলীলায়, নিঃসংকোচে, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে। বন্ধুদের যাদের সন্তান বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, তারাও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমাদের ভদ্র নাগরিকদের সন্তানদের ইংরেজি গালি নিয়ে চিন্তিত, মর্মাহত। বলাবাহুল্য আমাদের সমাজে এখন আধুনিকতার প্রথম পাঠ নেওয়া হয় ইংরেজি গালি দিয়েই।
এ কোন বাংলাদেশে আমরা বসবাস করছি? সন্তানদের শিক্ষার জন্য অঢেল অর্থ ব্যয় করে মহান দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি মনে করে পরম নিশ্চিন্তে বসে আছি আমরা। আমাদের সন্তানরা বাংলায় কথা বলবে, হাসবে, গাইবে। ঝগড়াও করবে বাংলায়, অবশ্যই শোভন অশোভনের সীমারেখা বুঝে নিয়ে। এইটুকু রুচিবোধ ওদের মাঝে দিতে না পারলে অভিভাবক আর শিক্ষক হিসেবে নিজেকে ক্ষমা করি কি করে?
আমাদের সন্তানদের শুধু বাংলা বলায় আপত্তি, তা নয়। বাংলা খাবার তাদের মুখে রোচে না, বাংলা পোশাক তাদের চোখে ধরে না। ধীরেধীরে বাংলা হয়ে পড়ছে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের একটা উপলক্ষ মাত্র। এরজন্য কি আমাদের সন্তানরা দায়ী? ওরাতো আমাদের দেখেই শিখছে। এই শহরে আজকাল বাংলা নামের কোন বিপণী, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, সৌন্দর্য চর্চাকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন! ফটকের মাথায় ইংরেজি/ হিন্দি/ ফরাসি/আরবি/ স্পেনীয়/থাই নামটা বাংলা হরফে লিখিত থাকলেই কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস এলে অনেক দৌড়ঝাঁপ দেখা যায় নগরে বন্দরে। একুশের উৎসব (!) শেষ হতে না হতেই থিতিয়ে যায় সমস্ত উত্তেজনা।
অনেক দাম দিয়ে কেনা বাংলাকে তো এমনি করে বাঁচানো যাবে না। কে এগিয়ে আসবে বাংলা বাঁচাতে? দায়টা কার? শুধুই কর্তৃপক্ষের? নাগরিকদের কি কোন দায় নেই? শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন যে শিক্ষাবিদগণ, তাঁরাই কি পারবেন দায় এড়াতে?
বাংলা বাঁচাতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, মনেপ্রাণে বাংলাকে ধারণ করতে হবে। কথায় ও কাজে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা বাঁচানোর এই সংগ্রামে ইংরেজি কিছুতেই বাংলার প্রতিপক্ষ নয়। ইংরেজি আমাদের শিখতেই হবে, বিশ্বজ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে, পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের জন্যে। প্রয়োজনে আরও পাঁচটা ভাষা শেখা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই মায়ের ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়, অবহেলা করেও নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁচার পথটুকু অন্তত মানুষ জানুক
পরবর্তী নিবন্ধহালদায় ঘেরা জাল জব্দ