বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃবৃন্দের জাতিকে মুক্ত করার দৃপ্ত ঘোষণা

ইতিহাসের ধারাপাতে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান

এ.কে.এম.আবু বকর চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৫ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা ঘোষণা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ-এক বিরাট ইতিহাস। ১৯৪০’র ২৩ মার্চ লাহোরের মিন্টু পার্কে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সম্মেলনে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির স্বাধীনতার দাবী করে প্রস্তাব উত্থাপনের পথ ধরে ৪৬’র এপ্রিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী – আবুল হাশিমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলার মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (১২১-১১৬) অর্জন এবং আবুল হাশিম-শরৎচন্দ্র বসুর মধ্যে ৫ দফা ভিত্তিক সম্পাদিত বাংলার “স্বাধীনতা চুক্তি” (২০ মে ’৪৭) নিঃশেষ হয়ে যায় ৪৭’র ১৪ আগস্টে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম।
’৫৪-র ৩-৬ মার্চে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট ২৩৭ আসনে ২২৮টিতে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়েও পশ্চিমা আমলাও সামরিক চক্রের ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ’৫৮-র ৭ অক্টোবর হতে ৭১-র ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রূপে সামরিক ও আমলাচক্র দেশ শাসন-শোষণ নিপীড়ন করে।
’৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সর্বদলীয় বিরোধী দলের নেতাদের বৈঠকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবী উত্থাপন করলে শুধু আওয়ামী লীগ ব্যতিত অন্য সবার তীব্র প্রতিবাদে তা অগ্রাহ্য হয় এবং ৬ দফা দাবী উত্থাপনের মধ্য দিয়ে সর্বাগ্র বাঙালিকে স্বাধীনতার আলো দেখালেন।
১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হল বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করে ও আওয়ামী লীগকে গতিহীন করে দেয়ার হীন লক্ষ্যে সামরিক আমলা ও আওয়ামী বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্র।
৬৬ হতে ৬৮ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে আজ গ্রেফতার করা হলে আবার কাল মুক্তি দিয়ে তারপর দিন আবার গ্রেফতার করে এক প্রহসনমূলক মানসিক নির্যাতন করা শুরু হল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে মুখ্য আসামী হিসাবে নামে কাটগড়ায় দাঁড় করানো হয় একমাত্র লক্ষ্য তাঁকে নিঃশেষ করে হত্যা করার। বাঙালি জাতিকে চেপে ধরে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেয়া।
কিন্তু ৬৯-র ২৪ জানুয়ারি এদেশের ছাত্র সমাজ (ছাত্রলীগ-এন.এস.এফ-ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া ও মেনন গ্রুপদ্বয়) ১১ দফা দাবী আন্দোলনের ডাক দিয়ে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলে। এ সময় এন.এস.এফ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে মাহবুবুল হক দোলন – ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্দোলনের সংযুক্ত হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের চাপে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলেন নেয়, ফলশ্রুতিতে ৭০-র ৭ ডিসেম্বর দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিদ্বীপ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং এরই মাধ্যমে বাঙালি জাতি বাংলার স্বাধীনতা প্রশ্নে রবার স্ট্যাম্প দিয়ে দেয়।
এই ঐতিহাসিক বিজয়কে স্বীকৃতি না দিয়ে জাতীয় সংসদের আহুত ৭১-র ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে পাকিস্তানী বুলেট-বেয়নেট ব্যবহার করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ বিক্ষুদ্ধ জনতার মাঝে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা কণ্ঠে ঘোষণা করলেন – ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এরই প্রেক্ষাপটে দৈনিক আজাদীতে ১ম পৃষ্ঠার ৪ কলামব্যাপী ৬৯-র ১৬ মার্চ রোববার প্রকাশিত ১৫ মার্চ শনিবার লালদিঘীর মাঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেই বক্তব্য দিয়ে ছিলেন তা নিম্নে সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপন করছি, “চট্টগ্রামের জনসভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের বজ্র কঠোর শপথ গ্রহণ – সর্বাধিক ত্যাগের বিনিময়েও ১১ দফা সংগ্রাম চালাইয়া জাতিকে মুক্ত করিব।”
স্টাফ রিপোর্টার # গতকল্য লালদিঘীর ময়দানে (মুজিব পার্কে) আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা কালে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এগার দফার সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার বজ্র কঠোর শপথ গ্রহণ করেন। ঢাকা হতে আগত ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সর্বাধিক ত্যাগের বিনিময়েও এই সংগ্রাম চালাইয়া যাইয়া জাতিকে মুক্ত করিবেন।
জেলা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি জনাব এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় কেন্দ্রীয় পরিষদের নেতৃবৃন্দকে জনসাধারণের সহিত পরিচিত করান হয়। নেতৃবৃন্দের সভায় পৌঁচিতে বিলম্ব হইলেও জনতা আগ্রহ ভরে তাঁহাদের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকেন। তাহারা সভাস্থলে পৌঁছেলে বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে ছাত্র-জনতা তাঁহাদিগকে অভিনন্দন জানান।
জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সাংগঠনিক কমিটির সদস্য জনাব ফখরুল ইসলাম মুন্সি বলেন, ১১ দফা আন্দোলন দুর্বার গতিতে চলিবে। যত বাধাই আসুক তাহা হাসিমুখে বরণ করিয়া লইব। ১১ দফার বিরোধীতাকারীগণকে জাতি কোনদিন ক্ষমা করিবে না।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহবুব উল্লাহ দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ১১ দফার সংগ্রাম চালাইয়া যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা নীতিতে বিশ্বাসী নই। গোলটেবিল বৈঠক আমাদিগকে কিছুই দিতে পারেনি, তাই গ্রামে-গ্রামে আমরা ১১ দফার বাণী পৌঁছাইয়া দেব।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব খালেদ মুহাম্মদ আলী বলেন, ‘১১ দফার নিকট অন্যায়ের দণ্ড ধ্বসে পড়েছে। সংগ্রামী জনতার নিকট নতি-স্বীকার করে সরকার বঙ্গ শার্দুল শেখ মুজিবকে মুক্তি, কুখ্যাত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হইয়াছে। তবুও সরকারের অপচেষ্টা বন্ধ হয়নি। দীর্ঘ ২১ বচরের নির্যাতিত মানুষের সহ্যের সীমা পার হইয়া গেছে, তাই জাতির নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে শেষ রক্ত বিন্দু দানে তারা পিছু নয়।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক বলেন, ১১ দফা এদেশের কৃষক, মজদুর, শ্রমিক ছাত্র জনতার হাসি ফুটিয়ে তোলার দাবী। কুচক্রীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে হইবে।
“ডাকসুর” সাধারণ সম্পাদক জনাব নাজিম কামরান চৌধুরী ১১ দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আপোষহীন সংগ্রাম চালাইবার আহ্বান জানান।
শহর ছাত্রলীগের সভাপতি মৌলভী সৈয়দ আহমদ এবং জেলা এন,এস,এফের যুগ্ম সম্পাদক জনাব কামালউদ্দিন আহমদ সভায় বক্তৃতা করেন।
সভাপতির ভাষণে জনাব আবু বকর চৌধুরী ১১ দফার সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার সংকল্প ঘোষণাকালে গোলটেবিল বৈঠক রায়ের সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, দেশের সহিত যাহারা বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে তাহাদিগকে জাতি ক্ষমা করিবে না। জেলা ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি আবু তাহের মাসুদ প্রস্তাবাবলী পাঠ করেন। উল্লেখ্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দৈনিক আজাদী জন্মকাল থেকে এক অনন্য ও বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে এসেছে।
লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি; সাবেক দফতর সম্পাদক (১৯৮৪-৮৬) – চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘অজস্র সাহসের সাহসী উচ্চারণ’
পরবর্তী নিবন্ধচোখের অভ্যন্তরীণ চাপ ও গ্লোকোমা