‘অজস্র সাহসের সাহসী উচ্চারণ’

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | মঙ্গলবার , ১৫ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যন্ত অঞ্চল দলিলাবাদ গাঁ-রাউজানের একটি উর্বর ও শান্তিপ্রিয় এলাকা। পারস্পরিক সহাবস্থান, সহমর্মিতা এখানে আয়োজন করেছে সম্প্রীতির পুনর্বিন্যাস। ভিন্নমতের অজস্র মানুষের আনাগোনা এখানে-তবুও কেমন যেন কোমল পরশ বয়ে যায় মুক্ত বিহঙ্গের মতন। সাহসের উচ্চকিত আবহের জয়গান শুরু হয় মুয়াজ্জিনের সুরে সুরে। স্বপ্নীল আকাশে যেন বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস- এলোমেলো সমৃদ্ধ ব্যাকরণ কখনো কখনো ধরা দেয় অনন্য। দলিলাবাদের এই মাটিকে উর্বর করেছে এক প্রসিদ্ধ মনিষী। যার পুরো জীবনটাই ছিল নিরহংকারের বাতিঘর। মানবিক, স্বল্পভাষী, খোদাভীরু মানুষটির পুরো জীবনটাই ছিল কঠোর পরিশ্রমের অসাধারণ পরাকাষ্টা। তিনি আর কেউ নন-মরহুম আতাহার আলী চৌধুরীর গর্বিত সন্তান মরহুম আব্দুল হাই (প্রকাশ হাফেজ বাদশা মিয়া)। আতাহার আলী চৌধুরীর বিয়ে হল উত্তর হিংগলা গ্রামের হরিষ খান চৌধুরী বাড়ীর এক ভদ্র পরিবারের বিবি বকুলুন্নিসা’র সাথে। তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ের নাম জোহরা খাতুন, ছেলের নাম বাদশা মিয়া। বাবার জন্ম আনুমানিক ১৯১২ সনে, নিতান্ত শৈশবাবস্থায় তিনি ছিলেন মাতৃহারা। পারিবারিক প্রতিকূলতার কারণে মেধাবী বাদশা মিয়ার শৈশব ও বাল্যবস্থায় লেখাপড়া করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। অনেকটা কৈশোর অবস্থায় নাঙ্গরমোড়াস্থিত রাউজানের প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল, প্রকৃত দ্বীনি শিক্ষার মশালবাহী একনিষ্ঠ সমাজসেবক ও রাউজান এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আমির আলী চৌধুরী (রহঃ) প্রকাশ বুড়া মৌলভী সাহেবের মক্তবে আমার বাবার শিক্ষায় হাতেখড়ি। ঐ মক্তবে বাংলা, গণিতও পাঠ্যবিষয় ছিল। বাবা দ্বীনি শিক্ষার প্রবল আকর্ষণে ১৯৩০ সনে ছুটে যান তৎকালীন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম আরবী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায়। ভর্তি হন সেখানকার হিফজখানার সর্বপ্রথম গ্রুপের শিক্ষার্থী হিসাবে। পরবর্তীতে উক্ত মাদ্রাসার শুরা বোর্ডের সদস্য ছিলেন আমৃত্যু। ফতেনগর মাদ্‌রাসার মুহ্‌তামিম ছিপাতলী নিবাসী হাফেজ নুরুল হক ছাহেব (রহঃ), হাটহাজারী মাদ্‌রাসার মুহ্‌তামিম হযরত হাফেজ মওলানা হামেদ ছাহেব (রহঃ), গড়দুয়ারা নিবাসী হযরত হাফেজ মওলানা রহমতউল্লাহ্‌ ছাহেব (রহঃ) প্রমুখ ছিলেন তাঁর সহপাঠীদের অন্যতম। তাঁদের উস্তাদ ছিলেন প্রখ্যাত হাফেযে-ক্বোরআন হযরত হাফেয মওলানা বদিউর রহমান গড়দুয়ারী ছাহেব (রহঃ)। পাঠ্যবস্থায় মাদ্‌রাসার মুহতামিম হযরত মওলানা হাবীবুল্লাহ্‌ ছাহেব (রহঃ) তাঁর সংশোধিত নাম রাখেন ‘আবদুল হাই’। মাত্র তিন বছরে দাওরসহ ক্বোরআনুল করিমের হিফ্‌য সমাপ্ত করেন তিনি। অতঃপর বাবা হাটহাজারী মাদ্‌রাসার কিতাবখানায় ভর্তি হন ১৯৩৩ সনে, জামাতে নওমে। ১৯৪১ সনে জামাতে উ’লা পাশ করে মাদ্‌রাসা থেকে ফারেগ হন। কথিত আছে, পাঠ্যাবস্থায় তিনি প্রায়ই পায়ে হেঁটে বাড়ী-মাদ্‌রাসা-বাড়ী যাতায়াত করতেন প্রতিদিন। তাঁর আসাতাজায়ে ক্বিরাম এর মধ্যে হাটহাজারী মাদ্‌রাসার মুহ্‌তামিম হযরত মওলানা আবদুল ওহাব ছাহেব (রহঃ), মওলানা আবদুল জলিল রামুভী ছাহেব (রহঃ), খতিবে আযম হযরত মওলানা ছিদ্দিক আহমদ চকরিয়াভী ছাহেব (রহঃ) হযরত মওলানা হাফিজুর রহমান প্রকাশ পীর ছাহেব (রহঃ), হযরত মওলানা হাফিজুর রহমান প্রকাশ পীর ছাহেব (রহঃ) প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। উ’লা পাশ করার পর ১৯৪১ সনেই বাবা শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোঙ্গরমোড়াস্থিত ‘আমির আলী মক্তবে’ ও পরে রাউজান এমদাদুল ইসলাম মাদ্‌রাসায়। অবশেষে শিক্ষক হিসাবে পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন শাহানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রকাশ ‘আবদুল করিম মাষ্টারের স্কুলে’। বেতন ছিল মাসিক ১৭ টাকা। ইতোমধ্যে তিনি শিক্ষক হিসাবে নিজেকে অধিকতর যোগ্য করে নেয়ার জন্য জি.টি’তে অংশগ্রহণ করেন ও ট্রেনিং-শেষে কামিয়াবীর সাথে সনদপ্রাপ্ত হন। অতঃপর শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন ক্রমান্বয়ে চিকদাইর আজিজীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, সামশু চেয়ারম্যানের বাড়ী-সংলগ্ন পূর্ব ডাবুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, হিঙ্গলা মুছা শাহ্‌ প্রাথমিক বিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শেষোক্ত বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সনে তিনি পেনশানভোগী শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসাবে পরম সন্তুষ্টির সাথে অবসর গ্রহণ করেন। কবরস্থান-সংলগ্ন হিঙ্গলা জামে মসজিদ, পূর্ব ডাবুয়া সামশু চেয়ারম্যানের বাড়ী-সংলগ্ন জামে মসজিদে অনেক বছর পর্যন্ত তিনি জুমার নামাজে ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। তা’ছাড়া রাউজান থানা-অফিসের অদূরবর্তীতে ফকিরহাট জামে মসজিদে, সুলতানপুর কাজীবাড়ী জামে মসজিদে, শাহানগর সিকদার মাতা জামে মসজিদে ও রাউজান এমদাদুল ইসলাম মাদ্‌রাসার জামে মসজিদে তারাবীহ্‌ নামাজে ইমামতের সাথে খতমে ক্বোরআন আদায় করেছেন অনেক বছর ধরে। তাঁর ক্বেরাতে সমকালীন প্রচলিত সুরেলা ঢঙের কিছুই প্রকাশ পেত না। শ্রুতিকটু ত্বরা-পঠনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। তাঁর জবানে তিলাওয়াতে ক্বোরআন ছিল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। কথা বলার মত এক নিয়মে একই গতিতে ক্বোরআন পাকের একেকটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারিত হত তাঁর কন্ঠে। মুক্তাদি স্রোতারা তিলাওয়াত শুনতে পারতেন স্বস্তির সাথে, গভীর মনোযোগের সাথে। পাক্‌ ক্বোরআনের প্রত্যেকটি শব্দ তাঁদের কর্ণ-কুহরে ঢুকে ক্বলবে প্রভাব ফেলত। তাঁরা হতেন মুগ্ধ, অন্তরের কানায় কানায় পরিতৃপ্ত। তিনি খতমে ক্বোরআনের কোন প্রকার বৈষয়িক বদলা গ্রহণ করেননি কোনদিন। তিনি বলতেন-‘খতম’ পড়ে যাঁরা রোজগার করেন, তাদের দেখেছি অল্প ক’দিন বেশ একটু তেলে-ঝোলে চলে, তারপর শুটকি- আমাকে আল্লাহ্‌ পাক সারা বছর একই রকম চালান’। স্বাধীনতা-সংগ্রামের আগে বছর ছ’য়েক কাপড়ের তৈরী পোষাকাদির ব্যবসা করেছেন তিনি রাউজান ফকিরহাটে। প্রতি রোববার ও বিষ্যুদবার থানা-সম্মুখস্থ বাউন্ডারী দেয়ালের বাইরে পূর্ব-পশ্চিমে সারিবদ্ধ দক্ষিণ পট্টিতে প্রায় মাঝখানে উত্তরমুখী একখানা অস্থায়ী ছোট দোকান খুলতেন জোহরের পর। আবার মাগরিবের পর তা’গুটিয়ে নিতেন। গাট্‌রী-বাঁধা মালামাল হিফাজতে রাখা হত শরিয়তুল্লাহ্‌র বাপের (হাজী আহ্‌ছান উল্লাহ্‌ সওদাগরের আব্বার) বড় দোকানটায়। বাড়ীর কাছাকাছি জমিগুলোতে চাষাবাদ করতেন তিনি। প্রয়োজনে জমিতে লাঙ্গলও চালাতো বাস্তবতাবাদী বাবা নিজেই। তিনি আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা। তাঁকে আমি পেয়েছি একজান মহান ও আদর্শবান পিতা হিসাবে, পেয়েছি যত্নবান ও দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসাবে। সদা হাস্য মুখটি এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। বাবা ছিলেন অদম্য শুভ্রতার প্রতীক, তাঁর মধ্যে ছিল না কোন উদ্দামতার পরশ, শান্ত সতেজ কোমল প্রিয় এক মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল মানবিকতায় ভরপুর। জীবনের পরতে পরতে অসম্ভব সংগ্রামের প্রতিফলন। আমাদের বাড়ীর সামনে একটি অতি প্রাচীন আমগাছ ছিল। এই আমগাছের তলায় পাড়ার শিশু-কিশোর, যুবা, বয়স্ক মহিলাসহ অসংখ্য গ্রামবাসীদের বিনামূল্যে আল-কোরআনের ছবক, দোয়া দরুদ ও জরুরী মাসালা-মাসায়েলও শিখাতেন। বিনিময়ে আব্বা কিছুই নিতেন না কারো কাছ থেকে। আমরা ভাই-বোনেরা যেন বাবার আদর্শে নিজের জীবনকে গড়তে পারি ও একজন মুত্তাকি ও দ্বীনদার হিসাবে আল্লাহর কাছে হাজির হতে পারি-আজ শুধু মহান রাব্বুল আ’লামিনের কাছে এই আরজটুকুই করছি। আমিন।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়েরা সাথে সাথে দেশও এগিয়ে নিয়ে যাবে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃবৃন্দের জাতিকে মুক্ত করার দৃপ্ত ঘোষণা