প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে

মোরশেদুল আলম কাদেরী | শনিবার , ১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

প্রবীণরা আমাদের বটবৃক্ষ, তাঁদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা নবীনের চলার পথের পাথেয়। প্রবীণ ব্যক্তিটি আমাদের পরিবার, সমাজ, দেশের কল্যাগে অনেক অবদান রেখেছেন। তাই এখন সময় এসেছে নবীনদের উচিত প্রবীণ ব্যক্তিটিকে তাঁর যথাযথ সম্মান, সেবা, সব ধরনের সহযোগিতা করা। এটা ভুলে গেলে চলবে না আজকের নবীন একদিন আপনিও হবেন প্রবীণ। বর্তমানের এই শহরের যান্ত্রিক জীবনে একজন প্রবীণ সবার জন্য আশীর্বাদ, তাই নয় কোনো অবহেলা, চাই প্রবীণের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
‘পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা’ স্লোগান নিয়ে বিশ্বের সব দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ শনিবার উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব বয়সী। প্রবীণ দিবস পালনের সূচনা হয় ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের এক ঘোষণার মাধ্যমে। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। এ প্রবীণ জনগোষ্ঠী পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে, তার খবর কেউ রাখে বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণরাই এই দেশ, সমাজ তথা পরিবারের জন্য একসময় বিরাট অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হল। ২০২১ সালে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালিত হয়েছে, অর্থাৎ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন, তাদেরও অনেকে আজ কমবেশি বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। বার্ধক্যের স্বাদ সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। জন্মিলে যেমন মৃত্যু অনিবার্য, তেমনি বেঁচে থাকলে প্রত্যেক মানুষকেই বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এ থেকে কোনো নিস্তার নেই। জাতিসংঘের আহ্বানে ১৯৯১ সাল থেকে অক্টোবরের প্রথম দিনটিকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রতি বছর দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবারের মূল প্রতিপাদ্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বিগত দুই বছর বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ তাণ্ডবের পর আমরা এ বছর কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালন করছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আমরা চট্টগ্রাম প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, বিগত দুই বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারি বিধিনিষেধ মান্য করে সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করেছি। আমরা গরীব দুখিনী অসহায় দুস্থ মানুষদের মাঝে যথাসম্ভব দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি এবং এখনো করে যাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের বোঝা মনে করা হয়। তাদের সম্মান, মর্যাদা কিংবা কষ্টের কথা কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলো তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশ অনেক বেশি উপকৃত হতে পারত। প্রতি বছরই তো দিবসটির প্রতিপাদ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু ওই একটি দিনেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটুকু নিরাপদ বা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এ খবর ক’জন রাখেন? প্রবীণরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আমাদের দেশে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। বিপুলসংখ্যক এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ তাগিদ দিয়েছে। বিগত বছরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় বিশ্ব অর্থনীতির পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এ পাঁচটি ঝুঁকির একটি হচ্ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী।
এ ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা বর্তমান সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখেছি। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রেরণ করে এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের জীবনধারণের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বদ্ধ পরিকর। বিশ্বের অনেক দেশসহ সার্কভুক্ত কোনো কোনো দেশে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। এদিক থেকে আমাদের দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ এবং পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এ আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করা এবং জাতীয় নীতিমালায় প্রবীণ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করা।আসলে যে যত কথাই বলুক না কেন, প্রবীণদের নিয়ে তেমনভাবে কেউ ভাবেন না বা কেউ কিছু করেন না। যদি ভাবতেন বা করতেন, তাহলে প্রবীণরা প্রতিনিয়ত এত নিগৃহীত হতেন না। অধিকাংশ গণপরিবহনে প্রবীণদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই।
কোনো কোনো পরিবহনে মহিলা, শিশু বা প্রতিবন্ধীদের জন্য সীমিতসংখ্যক আসন নির্দিষ্ট থাকলেও সেখানে পুরুষরা জায়গা দখল করে বসে থাকেন। এ সীমিতসংখ্যক আসনেও ইঞ্জিনের তপ্ত হাওয়া সহ্য করে বসতে হয়। পুরুষরা জায়গা দখল করে বসে থাকায় গাড়ির হেলপাররা মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের উঠতে বাধা দেয়। গাড়িতে জায়গা নেই এ অজুহাতে তাদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কেউ প্রয়োজনের তাগিদে ঠেলাঠেলি করে উঠলেও তাকে আসন ছেড়ে দেয়া হয় না। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা অবহেলিত হবেন, এটা মেনে নেয়া যায় না। প্রবীণদের জীবনের মানোন্নয়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে আমাদের দেশেও বাস্তবায়ন করা হোক- আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এটাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব প্রবীণ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার
পরবর্তী নিবন্ধমহেশখালীতে কলেজ ছাত্র হত্যা মামলায় পিতা-পুত্র গ্রেপ্তার