বিশ্ব প্রবীণ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার

ডা. দুলাল দাশ | শনিবার , ১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

প্রবীণ হলেও বলো না কখনো প্রবীণ/ মনটা প্রতিক্ষণ রেখো নবীন/ প্রবীণের মাঝে নবীন লুকায়িত/ নবীন থেকেই নবধারা প্রবাহিত। ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রবীণদের প্রতি অবহেলাকে বিবেচনা করে উত্তরণের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯০ সাল থেকে ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ‘প্রবীণ দিবস পালন করা হয়। মানব জীবনে শিকু, কৈশোর ও যৌবনকাল পার করে আসে বার্ধক্য বা প্রবীণতা। আমরা ভুলে যাই বেঁচে থাকলে জীবনের একটা সময় আমাদের প্রবীণ হতেই হবে। এটা চিরন্তন, একটা জীবন চক্র বা পরিক্রমা। এটা শুধু মানুষের বেলায় নয়। জীবজন্তু, পশুপাখি এমন কি বৃক্ষদের বেলায়ও। সুতরাং কারো ভাববার অবকাশ নেই যে ‘আমি বৃদ্ধ হব না’। সুতরাং এখানে শক্তি বা বল প্রদর্শনের কিছুই নেই। জনাব এ.পি.জে আবদুল কালাম বলেছেন, কেউ কারো থেকে শক্তিমান নয়, একমাত্র শক্তি ‘কাল বা সময়’। তিনি বলেন, ‘আজ হয়তো তুমি শক্তিশালী- কিন্তু সময় তোমার থেকেও বেশি শক্তিশালী’। কারণ সময়ে তুমিও একদিন নুইয়ে পড়বে। সুতরাং জীবনে কাকেও মনে বা শারীরিকভাবে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। প্রবীণ মানে সেকেলে, অথর্ব, অক্ষম, অসুস্থ এবং সংসারের বোঝা নয় তারাই আজকের এই সুন্দর সমাজ গড়ার কারিগর। তারা সমাজ ও পরিবারের সম্পদ। তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, কর্মময়তা সদা প্রাসঙ্গিক। অথচ চরম অবহেলা, অবজ্ঞা, তাদের প্রতি উদাসিনতা তাদের মনকে ভীষণভাবে আহত করে। কিন্তু চিন্তা করতে গেলে আমরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। একাকিত্ব, পুত্র কন্যা ও আত্মীয় স্বজনের সাহচর্য্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হয়। মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা শুনা যায় যে বৃদ্ধ মাকে এয়ারপোর্টে বসিয়ে রেখে, ‘আমি আসি বলে’ প্লেনে চড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। ভাগ্যাহত মায়ের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। রেলওয়ে স্টেশনে বা বাস স্টপেজে বৃদ্ধ মা বা বাবাকে বসিয়ে রেখে ছেলে উধাও হয়ে গেছে। আধুনিক জগতে ছেলের বউরা বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়িকে সহ্য করতে চায় না। ছেলের বিশাল ফ্ল্যাট কিন্তু মা-বাবার স্থান সেখানে নেই। তাই অগত্য বৃদ্ধাশ্রম। এ রকম অনেক করুন কাহিনি শুনা যায়। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ অরক্ষিত, অসহায়, বিচ্ছিন্ন ও দুর্ব্যবহারে জর্জরিত। ফ্রান্সিস বেকেনের মতে, নৈতিক জগতে-নবীনদের প্রাধান্য আর প্রজ্ঞার জগতে প্রবীণদের। পল রবসনের মতে- সবাইকে একদিন প্রবীণ হতে হবে। যুবক-যুবতীদের এ কথাটি মনে রাখা উচিত। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র কামবকসকে লেখা একটা চিঠিতে বলেছিলেন- ‘আজ আমি বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ, শরীর একান্ত দুর্বল, আমার বিগত জীবনে আমার কত লোকবল, ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যইনা ছিল। আজ আমার জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলো চলে গেছে। আছে শুধু অস্থি চর্ম আর কঙ্কাল। আজ আমি একা, অসহায়, অস্থির ও বিমূঢ়’। প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ব শুধু পরিবারের নয় বরং গোটা সমাজের। প্রত্যেকের উচিত তাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। কারো আচরণে তারা যেন কষ্ট না পায়। মনে রাখা উচিত আজ যারা নবীন আগামীতে তারা প্রবীণ। দুর্বল স্বাস্থ্য, উপার্জনহীন একজন প্রবীণ ব্যক্তি কর্মস্থলে, পরিবারে, হাসপাতালে, বাজার ও ডাকঘরে, পেনশান তোলার কেন্দ্রে, চিত্তবিনোদনস্থলে, পেশাজীবীদের কাছে অনাহুত, উপেক্ষিত। কিন্তু মনে রাখা উচিত সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে প্রবীণদের মর্যাদা সবার উপরে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে তাদের মর্যাদা আলাদা এবং মানসম্মত। সেখানে সর্বক্ষেত্রে তাদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা আছে। সিনিয়র সিটিজেনদের সব কিছুতে কনসেশন দেওয়া হয়। সম্মান প্রদর্শনের জন্য বাসে, ট্রাকে, ট্রেনে তাদের সিট নির্দিষ্ট করা থাকে। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সে ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তা আছে।
বিশ্ব প্রবীণ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক প্রবীণদের আমরা সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে সম্মান প্রদর্শকপূর্বক যথাযথ মূল্যায়ন করব। তাদের পরিবারের ও সমাজের বোঝা মনে করবো না। বৃদ্ধদের সম্মান করতে না পারি অসম্মান করবো না। জয় হোক প্রবীণদের।

লেখক : প্রাক্তন চীফ
অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুষম খাদ্য প্রয়োজনীয়তা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে