প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৯ জুন, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের হাজীর সেবার শত বছর

চট্টগ্রামের অন্যতম দানবীর, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর। তিনি ব্যবসার মাধ্যমে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে জনগণের কল্যাণে বহুমুখী অবদান রেখে গেছেন। তৎমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে আরবে দুই পবিত্র নগরীতে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা ১৯২২ সালে।

পবিত্র মদিনায় উন্নয়নের কারণে এখানকার মুসাফিরখানা তৃতীয় পর্বে এসে আজ বর্তমান রয়েছে, তাঁর ওয়ারিশদের অতি কষ্টের ফসল হিসেবে। কিন্তু পবিত্র মক্কায় জিয়াদে দুষ্টলোকের হাতে তদারকির দায়িত্ব পড়ায় তা এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হল না। পবিত্র মদিনায় হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানা মসজিদে নববীর তুর্কি আমলের সম্প্রসারণ ও বাদশাহ আবদুল আজিজ পরবর্তী বাদশাহ ফয়সল কর্তৃক পুনঃ নির্মিত এরিয়ার পূর্ব-উত্তর পার্শ্বে ছিল। এ মুসাফিরখানা ছিল ৩-৪ তলা মাটির দেয়াল, খেজুর গাছের বিম।

নবী পাক (স.) পবিত্র মদিনায় হিজরতের পর পর মসজিদে নববী নির্মাণ করেন। আমিরুল মুমেনীন হযরত ওসমান গণি (র.) প্রথম সম্প্রসারণ করেন।

পরবর্তীতে ওমাইয়া ও আব্বাসী আমলে ছোটখাট সম্প্রসারণ করা হয়। তুর্কি আমলে এ মসজিদে নববী মজবুত আকারে পুনঃ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে তুর্কি সুলতানরা উত্তর দিকে সম্প্রসারণ করে। এ সম্প্রসারণে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র.) ও হযরত ওমর (র.) খেলাফত কার্যালয়ের স্থানকে উন্মুক্ত তথা খোলা রেখে অন্য দিকগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। তুর্কি আমলে নির্মিত মসজিদে নববীর অবকাঠামোর মডেল ইস্তাম্বুলের তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

তুর্কি নির্মিত উত্তর দিকে বর্ধিত অংশটি বাদশাহ আবদুল আজিজ সরিয়ে পুনঃ নির্মাণ শুরু করেন ঠিক একই স্থানে। বাদশাহ ফয়সালের আমলে কাজের সমাপ্ত হয়। এ সময় মসজিদে নববীতে ২০/৩০ হাজার নর-নারীর নামাজের সংকুলান হত। এই পর্যায়ে মসজিদে নববী পরিচালিত হয় ২/৩ শত বছর বা তার কম বেশি সময়।
এই মসজিদে নববীর চারদিকে রাস্তা ছিল, যা দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করত। চারদিকে রাস্তার বাহির সংলগ্ন রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ঘর-বাড়ি ছিল।

এমনি অবস্থায় দানবীর হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর ১৯২২ সালে এই মসজিদে নববীর পূর্ব-উত্তর পার্শ্বে রাস্তা সংলগ্ন একটি মুসাফিরখানা নির্মাণ করেন বা খরিদ করেন; তা ছিল ৩/৪ তলা।

১৯৭০ এর দশকে হজ্ব ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে আসার সৌদি আরব গমন করার সৌভাগ্য হয় আমার, তখন এ মুসাফিরখানায় যাওয়া হয়েছিল। হজ্ব মৌসুম বিধায় তখন যেয়ারতকারীদের অবস্থানে ভরপুর ছিল। এই সময় আল জামেয়া ইসলামিয়া তথা পটিয়া জমিরিয়া মাদ্‌রাসার প্রধান হযরত হাজী ইউনুস (রহ.)কে তদারকিতে আছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। সেই সময় আমার অনেকটা যৌবনকাল। আব্বাজানের পুত্র জানতে পেরে তিনি আমাকে আদর সোহাগের পাশাপাশি সম্মান দেখান। জানবার, দেখবার ও বুঝবার কৌতুহলী ছিলাম বিধায় এ মুসাফিরখানার আরও ২ শত মিটার পূর্ব উত্তরে ইসলাম খানের মুসাফিরখানায়ও যাওয়া হয়েছিল।

১৯৭০ এর দশকে হজ্ব মৌসুমে পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববীতে আমাদের নামাজ পড়তে অত্যধিক কষ্ট হচ্ছিল। যারা অনেক আগে আগে আসতে পারেন তাঁরা অল্প সংখ্যকের মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে জায়গা পেত। বাকী অধিকাংশ যেয়ারতকারী রাস্তায়, দোকানে, রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে ঘরের নিচতলায় ঢুকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হচ্ছিল।

এমনি পরিস্থিতিতে বাদশাহ ফাহাদ মসজিদে নববী বিশালভাবে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন ১৯৮৫ সালে। আগের চেয়ে ৮/৯ গুণ বড় আকারের দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদে নববীতে আজ ৬/৭ লাখ যেয়ারতকারী ৫ ওয়াক্ত জামাত পড়াসহ অতি আরামে এবাদত বন্দেগী করতে পারছেন। তিনি সম্প্রতি ও শত বছর বা তারও আগের যাবতীয় অবকাঠামো ভেঙ্গে মদিনা মোনাওয়ারা নগরীকে নতুনভাবে সাজিয়ে যান। এতে হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানা পূর্ব উত্তর দিকে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ এ ঘরের পরিবর্তে সৌদি সরকার আরেকটি ৭/৮ তলা দালান প্রদান করেন ৪/৫ শত মিটার দূরত্বে। তখনও মুসাফিরখানা বলা হলেও একে স্টারমানের হোটেল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এখানে ২/৩ জন বা ৪/৫ জন থাকতে পারে মত কক্ষ ছিল। ছিল আরামের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা। আশেপাশে ছিল ৩/৪ টি রেস্টুরেন্ট। অপরদিকে ইসলামখানের মুসাফিরখানাও এ ভাঙ্গনে পড়ে। তাদেরকে প্রদান করা হল আরেকটি দালান মসজিদে নববীর পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রায় ৮/৯ শত মিটার দূরত্বে।

১৯৭৬/৭৭ সালে ঢাকা সৌদি দূতাবাস খোলা এবং পর পর সৌদি এয়ার লাইন চালু করা থেকে প্রায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত হজ্ব ও ওমরাহ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এ সময় আমি নিজেও অনেক বার জেদ্দা গিয়ে সৌদি ডমেস্টিক ফ্লাইটে পবিত্র মদিনায় গমন করতাম। চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের মুসাফিরখানায় অনেক বার আরামদায়ক অবস্থান করা হয়েছিল। সার্ভিস চার্জ হিসেবে দৈনিক ১০ রিয়ালের বিনিময়ে।

পরবর্তীতে সৌদি সরকার এ মুসাফিরকানা দালানও ভেঙ্গে ফেলে মসজিদে নববীর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছোট বড় ২টি দালান প্রদান করে। তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাঁন্দ মিয়া সওদাগর পরিবারের সদস্য কর্ণেল (অবঃ) ইকবাল ও তার চাচা ডা. মুহসিনের অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এ দুই মুসাফিরখানার আয় থেকে প্রতি বছর ৩০/৪০ জন নর-নারীকে হজ্বে প্রেরণ করা হচ্ছে।

মুসাফিরখানার শত বছর চলমান। এ উপলক্ষে পরিবারের পক্ষে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীর চন্দনপুরাস্থ সাফা আর্কেড হল রুমে হজ্বযাত্রীগণের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। কর্ণেল (অবঃ) ইকবালের আমন্ত্রণে আমারও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক একুশে পদকপ্রাপ্ত জনাব এম.এ মালেক। সভাপতিত্ব করেন চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের নাতি সাবেক লায়ন্স গর্ভনর মোস্তাক হোসেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে কর্ণেল (অবঃ) ইকবাল পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার মুসাফিরখানা দুইটির দীর্ঘ বর্ণনা দেন। তিনি তার চাচা ডা. মুহসিনকে নিয়ে বারে বারে সৌদি আরব গমন করার মাধ্যমে অনেক অজানা কথা জানা যায়। এতে তারা পবিত্র মদিনার মুসাফিরখানা দুইটি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। পবিত্র মক্কার জিয়াদে অবস্থিত মুসাফিরখানাটি উদ্ধার করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। এডভোকেট সিরাজের উপস্থাপনায় আরও বক্তব্য রাখেন মেহেদীবাগ জামে মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ও লায়ন্স গভর্নর সামশুউদ্দিন সিদ্দিকী।

জনাব এম.এ মালেক প্রধান অতিথির বক্তব্যে চাঁন্দ মিয়া সওদাগরের অবদান এবং মুসলমানগণের আদর্শ নৈতিকতা নিয়ে শিক্ষণীয় বক্তব্য রাখেন।

হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর চট্টগ্রাম মহানগরীর চট্টগ্রাম সমশের পাড়ায় ১৮৬৯ সালে ৭ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। মৌলিকভাবে তিনি ব্যবসায়ী তথা সওদাগর ছিলেন। সেই ব্রিটিশ আমলে ব্যবসা মানে হালাল রোজগার। তাঁর আয়ের টাকা পরিবার-পরিজনের কল্যাণে ব্যয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় কাজে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে উদার মনে খরচ করে গেছেন।

দেশে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান ১৯১৩ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে চন্দনপুরা দারুল উলুম মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করা। এই মাদ্‌রাসাকে এই অঞ্চলের মাদ্‌রাসা জগতের মা বলা হয়। দেশের অনেক অলি দরবেশ এই মাদ্‌রাসার ওস্তাদ বা ছাত্র। তিনি প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৩৩ সালে ইন্তেকাল পর্যন্ত এই মাদ্‌রাসার সেক্রেটারী তথা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।

হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর দেশে তথা চট্টগ্রাম মহানগরীতে নিজের অর্থায়নে একাধিক রাস্তা, ব্রীজ, মাদ্‌রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। খাতুনগঞ্জে চাঁন্দ মিয়া লেইন তাঁর স্মৃতি বহন করছে।

হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর ইন্তেকালের আগে তাঁর অর্জিত সম্পত্তি থেকে একটি অংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ওয়াকফ করে দেন। ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁর শারীরিক ও আর্থিক অবদান আমাদের দেশের ব্যবসায়ী শিল্পগণের জন্য অনুকরণীয় অনুসরণীয়। সেই ব্রিটিশ আমলে তাঁর অর্জিত সম্পদ শতভাগ হালাল বলা যাবে। একালে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়পরায়ণ হালাল আয়ের ভাল মানুষ হাজারে কয়জন পাওয়া যাবে ভাববার বিষয়। আরও ভাববার বিষয় ধর্মীয় কাজে জনকল্যাণে তাদের দান হালাল না হলে এর প্রতিদান কি হতে পারে! হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর ১৯৩৩ সালে ইন্তেকালের সময় ৬ পুত্র একাধিক কন্যা সন্তান রেখে যান।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে বসতঘরে ডাকাতি, নারীসহ আহত ১০