দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ জুন, ২০২২ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

(পূূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ রাত অবধি জমজমাট খাওয়া দাওয়া চললো। চললো আনন্দ উৎসবও। চীনারা সাঁঝরাতে ডিনার সারেন একথা ঠিক, তবে যুতসই আড্ডা পেলে তারা যে ডিনারের নামে রাতও কাবার করে দিতে পারেন তা তো চোখের সামনে দেখতে পেলাম। কী জমজমাট আড্ডা, কী জমজমাট আসর! তাইজু চেম্বারের বাঘা বাঘা সব নেতা কী অনাবিল আনন্দ যে বিলুচ্ছিলেন! বাংলাদেশের ছোট্ট প্রতিনিধিদলটির বিশেষ কোন গুরুত্ব না থাকলেও তারা তাদের ভালোবাসায় সকলকে সিক্ত করছিলেন। এদের কারো কারো বাংলাদেশে প্রচুর ব্যবসা রয়েছে, কেউবা ভবিষ্যতে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা তথ্য উপাত্তও জানতে চাচ্ছিলেন। তাদের অনেকের চোখে মুখে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। আমরা সেই স্বপ্নকে উসকে দিচ্ছিলাম। বলে রাখা ভালো যে, তারা কোন ইংরেজীর ধার ধারছিলেন না। নিজেদের ভাষায় অবলীলায় কথা বলছিলেন। আমরা মিজ জেসি এবং লায়ন ফজলে করিমের মাধ্যমে কথা বলছিলাম। এতে করে বাংলা, ইংরেজি এবং ম্যান্ডারিন (চীনা) ভাষার এক জগাখিচুড়ি আলোচনা হলেও স্বপ্নগুলো কেবলই বড় হচ্ছিল। অবশ্য, আমি চুনোপুটি একজন রিপোর্টার, বড় স্বপ্ন দেখার অভ্যাস নেই। তাই এসব ‘স্বপ্ন-টপ্ন’ আমাকে স্পর্শ করলেও নিজে কোন স্বপ্ন দেখছিলাম না। সহযাত্রীদের ব্যবসার প্রসার কিংবা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়বে এতেই আমার শান্তি, স্বস্তি। ধুমায়িত গ্রি টি’র মগে চুমুক দিতে দিতে আমি ব্যবসায়ীদের আলোচনা শুনছিলাম। তবে একটি জিনিস দেখতে খুব মজা পাচ্ছিলাম যে, ব্যবসায়ীদের অনেকেই বোতলের পর বোতল সাবাড় করছিলেন। এত মদ খেয়ে এরা কী ঘরে ফিরবেন! আজ এদের হাড়গোড় কী আস্ত থাকবে!! নাকি এদের বিবিরা সর্বংসহা কে জানে!

বেশ রাতে আসর ভাঙ্গলো। ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন, আমরাও। বিশাল লিফট ধরে যখন নামছিলাম, তখন ব্যবসায়ীদের অনেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। কিন্তু লিফট থেকে বের হতেই সিগারেট জ্বালালেন কেউ কেউ। মদে বুঁদ হয়ে থাকার মাঝেও সমানে সিগারেট ফুকছিলেন তারা। একটি বিষয় খেয়াল করলাম যে, চীনারা প্রচুর সিগারেট টানে। রাতে দিনে টানে। গ্রিন টি এবং সিগারেট যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। শুধু পুরুষই নয়, চীনা মহিলারাও কোন ধরনের রাখঢাক না করেই সিগারেট ফুকেন। হাতে মোবাইলের সাথে সিগারেটের প্যাকেট এমনভাবে রাখেন যে, বেশ লাগে! জিন্স স্কার্ট পরিহিত কিংবা স্যুটেট মহিলাদের সিগারেট ধরানোর স্টাইলই যেন আলাদা!

তাইজুতে আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। সকালেই আমাদের ফ্লাইট। সুতরাং এত রাত অব্দি আসর জমানো কতটুকু ঠিক হলো বুঝতে পারছি না। অবশ্য দশটা নাগাদ এয়ারপোর্টে গেলে চলবে। তাইজু এয়ারপোর্ট, অভ্যন্তরীন বিমানবন্দর। সেনাবাহিনী নিজেদের প্রয়োজনে যুদ্ধকালীন বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুললেও ক্রমে সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বিমানবন্দরে পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দরটি আমাদের হোটেল থেকে নাকি খুব বেশি দূরে নয়, বিশ মিনিটের ড্রাইভ। সকালে রাস্তায় ট্রাফিক বেশি থাকবে, তাই হয়তো আধা ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বেরুতে হবে। শহর থেকে বেরুনোর পর তেমন একটা ভীড়-ভাট্টা হবে না বলেও আশ্বস্ত করলেন তারা। অবশ্য তারা ফ্লাইটের সিডিউল টাইমের এক ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বললেন, ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। তবে ট্রাফিক অনেক।
আমি মনে মনে বললাম, তা আর বলতে! চীন সম্পর্কে হালকা ধারণা হয়ে গেছে। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের বিশাল দেশটির সবকিছুই বড় বড়। বিশাল বাজার, বিশাল অর্থনীতি। সব জায়গাতেই ভিড়, প্রচুর মানুষ। ফলে তাইজু ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট হলেও যে প্রচুর যাত্রী হ্যান্ডলিং করে তা আমি মোটামুটি নিশ্চিত।

ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। গভীর ঘুমে পার হয়ে গেছে পুরো রাত। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন শরীর মন সবই ফুরফুরে। আজ তাইজু থেকে চলে যাবো, একটু পরই বের হবো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। তবে আগে নাস্তা সারতে হবে। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট, দারুণ একটি ব্যাপার। এয়ারপোর্টের তাড়া না থাকলে ব্যুফে ব্রেকফাস্ট শুধু পেটই নয়, একেবারে বুকও ভরিয়ে দেয়। রকমারি খাবারের পর চুক চুক করে দুই দফা কফি খেয়ে রয়ে সয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় নিজেকে রাজা রাজা মনে হয়। এজন্যই মনে হয় ব্রিটিশেরা রাজার মতো ব্রেকফাস্ট করার পরামর্শ দেয়!

তাইজু বিমানবন্দরে পৌঁছে আমার চোখ কপালে না উঠলেও তাক লেগে গেল। ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টেও এত যাত্রী! চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে! প্রথম দর্শনে বেশ বুঝতে পারলাম যে, চেক-ইন করতে বেগ পেতে হবে। লম্বা লাইনের পেছনে পড়ার কষ্ট অনেক। সামনের জন হাঁটতেই চায়না। হাঁটলেও কেমন যেন হেলেদুলে হাঁটে! ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় গ্রুপ চেক-ইন করার সুযোগ নিলেও চীনের এই ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে সেই সুবিধা কতটুকু পাবো বুঝতে পারছিলাম না। এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তাকে পটাতে হলে ইংরেজীতে আলাপ করতে হয়, কিংবা বাংলায়। এখানে চীনা ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলা আমার কথা কতটুকু বুঝবেন বা আদৌ বুঝতে চাইবেন কিনা কে জানে! কাঠখোট্টা টাইপের পুরুষের পরিবর্তে চ্যাপ্টা নাকের কোন তরুণী কর্মকর্তা পাওয়া গেলে ভালো, পটাতে সুবিধা হতো বলেও মনে হলো। অতীতে বিভিন্ন সময় দেখেছি যে, এসব ক্ষেত্রে পুরুষ কর্মকর্তাদের চেয়ে মহিলা কর্মকর্তারা বেশি সহযোগিতা করেন।

চায়না সাউদার্ণের কাউন্টার খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না। কিন্তু সামনের লোকজন দেখে এগুনোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। ও হ্যাঁ, আমরা চায়না সাউদার্ণ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে চড়ে তাইজু থেকে গুয়ানজু যাবো। শহর দুইটি চীনের, তবে একটি থেকে অপরটির দূরত্ব ১০২৩ কিলোমিটার। আকাশে উড়তে হবে ২ ঘন্টা ১৫ মিনিট। ডোমেস্টিক হলেও একেবারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের মতো উড়াউড়ি, চট্টগ্রাম থেকে দিল্লী চলে যাওয়ার মতো ব্যাপার স্যাপার। গ্রুপ চেক-ইনের সুবিধা পেলাম না। লম্বা লাইনের পেছনে থেকে টুকটুক করে এগুচ্ছিলাম।

শত সহস্ত্র মানুষ, গিজগিজ করছে। এত মানুষ বিমানে ভ্রমন করে? বিশাল দেশ চীন, দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানাভাবে নানাকাজে ছুটছে মানুষ। দেশটির এক শহর থেকে অপর শহরের দূরত্ব কোথাও কোথাও পাঁচ সাত হাজার কিলোমিটারও রয়েছে। এক শহরের সাথে অপর শহরের জীবন জীবিকার কোন মিল নেই, মিল নেই বহু এলাকার মানুষের সাথে অপর এলাকার মানুষের সংস্কৃতির। চেহারারও যেন অমিল রয়েছে এক অঞ্চলের সাথে অপর অঞ্চলের বাসিন্দাদের। বহু কিছুর মিল না থাকলেও ব্যবসা বাণিজ্যের কারনে মানুষ প্রচুর ট্রাভেল করে, চীনের এক শহর থেকে অন্য শহরে হরদম ছুটছে বিমান, ট্রেন, বাস। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষও দূরযাত্রার বেশির ভাগই সম্পন্ন করেন বিমানে। প্রচুর যাত্রী থাকার কারনে বিমানের টিকেট তুলনামূলক সস্তায় জুটে। আবার সস্তায় জুটে বলে মানুষ অনায়াসে বিমানে ট্রাভেল করে। এ যেন চমৎকার একটি চক্র। প্রচুর যাত্রী থাকার কারনে চীনের ফ্লাইট অপারেটরেরা সস্তায় টিকেট বিক্রি করতে পারে, প্রতিটি ফ্লাইট যাত্রীতে ঠাসা থাকার কারনে তাদের লোকসানের ভয় থাকে না।

অপরদিকে বিমান কোম্পানিগুলো সস্তায় টিকেট বিক্রি করে বিধায় যাত্রীরা অতি আয়েশে আকাশে উড়তে পারে। আমাদের দেশের চিত্র পুরোপুরি উল্টো। আমাদের টিকেটের দাম বেশি হওয়ায় বহু মানুষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিমানে যাতায়ত করতে পারেন না, আবার যাত্রী সংখ্যা কম থাকায় বিমান কোম্পানিগুলো টিকেটের দাম কমাতে পারে না। অর্ধেক ফ্লাইটে যাত্রী নিয়ে টিকেটের দাম কমানোর কথা যেন আমাদের ফ্লাইট অপারেটরেরা চিন্তাও করতে পারে না। যাক, আদার বেপারী হয়ে জাহাজের খবর নেয়া যেমন জরুরি না, তেমনি খবরের কাগজের চুনোপুটি এক রিপোর্টারের পক্ষে দেশের বিমান পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানোও ঠিক হচ্ছে না।

আমাদের সামনে অনেক মানুষ। নারী পুরুষ, শিশু কিশোরও আছে। তারা একটু একটু করে সামনের দিকে যাচ্ছিলেন, এগুচ্ছিলাম আমরাও। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি আইনুন নাহার : মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ