নারীর প্রতি সহিংসতা এবং এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল

ফজিলাতুন নেসা | শনিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

খুব সহজ নারীকে আক্রান্ত করা, খুব সহজ নারীকে নিগৃহীত করা। যে কোন যুদ্ধেও এটাই অন্যতম কৌশল থাকে। নারীকে আক্রান্ত করলে, একটা জাতি বা গোষ্ঠীকে দীর্ঘসময় ধরে মানসিক নিপীড়নের মধ্যে রাখা সম্ভব। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ থেকে শুরু করে ২০২১ এসেও সেই একই ধারাবাহিকতার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। ৭১-এ শারীরিকভাবে নারীদের যে ধর্ষণ করা হয়েছিলো, তার পেছনে মনস্ত্তত্ত্ব ছিলো সেই নারীটিকে সারাজীবন ধরে অসংখ্যবার মানসিক ও সামাজিক ধর্ষণের মধ্যে রাখা। যাতে করে,একজন নিগৃহীত নারীর জীবন কাটে নানা অপমানের মধ্য দিয়ে। ঠিক পাশপাশি যুদ্ধে কাছের মানুষ বা পরিবারের সামনে নারীকে শারীরিক নিগ্রহ করা মানে হলো- সেইসব পুরুষদের মধ্যে একটা ভয়াবহ ভয় তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, সেই পুরুষ বা সমাজ যেন সারাজীবন ধরে সেই স্মৃতি বহন করে চলে, তার ব্যবস্থা করা। খুব সহজভাবে আমরা যেটিকে বলতে পারি, ‘শিক্ষা দেওয়া।’ এমন শিক্ষা নারীকে ১৯৭১ সালে দেওয়া হয়েছিলো যে সেইসব দুর্বিষহ স্মৃতি শুধু আক্রান্ত নারীরাই নন, প্রজন্মর পর প্রজন্ম তা মনে রাখতে বাধ্য হয়েছে।
এসব সহিংসতার ফলাফল হিসেবে যখন এরকম দুর্বিষহ স্মৃতি যে মানুষ সারা জীবন ভুলতে না পারে, তার হতে পারে কঠিন এক মানসিক রোগ। যুদ্ধকালীন নারীর প্রতি মারাত্মক সব সহিংসতা ভুক্তভোগী সেই নারীটিসহ তার পরিবার এবং কমিউনিটিকে ঠেলে দিতে পারে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার (চঞঝউ) এর দিকে। যেই অসুখটির চিকিৎসা না হলে, হতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। যার ফলাফল হয়তো আমরা সমাজে দেখছি, কিন্তু সচেতনতার অভাবে বুঝতে পারছি না।
এই অসুখটির অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে একটা বড় লক্ষণ হলো- চিন্তা এবং মুডের বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই অসুখে ভুগলে ব্যক্তির
* নিজের সম্পর্কে, অন্য মানুষের সম্পর্কে এবং তার চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে;
* ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়তে পারে
স্মৃতিশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে
* যে কোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অপারগতা/সমস্যা দেখা দিতে পারে
* চারপাশের সকলের প্রতি অনুভূতিশূন্যতা দেখা দিতে পারে
* ইতিবাচক আবেগ প্রকাশে সমস্যা দেখা দিতে পারে
শুধু যে যুদ্ধকালীন অবস্থার কারণে এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার (চঞঝউ) সহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা/ অসুখ হতে পারে তা কিন্তু নয়। পুরুষতান্ত্রিক এই দেশে/সমাজে, ২০২১ সালে প্রায় ৫০-৭০ শতাংশ নারী এমনিতেই তার জীবনের কোন না কোন সময়ে বিভিন্ন কায়দায় শারীরিক, মানসিক অথবা আবেগের ক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। কারণ একমাত্র নারীকে আক্রান্ত করলেই তার পুরো পরিবার, কমিউনিটি অথবা কোন গোষ্ঠীকে ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ প্রদান করা সম্ভব, এই সমাজের মানসিক গঠনটা অনেকটা সেরকমই হয়ে উঠেছে।
একটা গবেষণায় বলা হচ্ছে, যে কোন সহিংসতার সাথে মানসিক সমস্যার চারভাবে যোগাযোগ তৈরি করে। Sometimes the violence predisposed the mental illness, sometimes it precipitated it, while other times it maintained and was a consequence of it. Sometimes the violence may be unrelated to the mental illness.
এসব মানসিক সমস্যা বা অসুখগুলো কেমন হবে, তার অনেকটাই সহিসংসতার মাত্রার উপর নির্ভর করে। বিশ্ব জুড়েই নারীকে তার ঘরে-বাইরে এবং তার কাজের ক্ষেত্রে নানাভাবে সহিংসতার শিকার হতে হয় তার জীবদ্দশায় নানা সময়ে। সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশে নারীর অবস্থা-অবস্থানের কথা বলাই বাহুল্য। নারীই হলো একমাত্র সহজ টার্গেট যাকে আক্রান্ত করে ক্ষমতা প্রদর্শন করা খুব সহজ।
নারী মানেই সমাজের চোখে সংখ্যালঘু এবং সহজ টার্গেট। তাকে যখন-তখন যা খুশি চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার দিকে আঙ্গুল তোলা হয়। ধর্মীয় বিধান দিয়ে তাকে চারিদিক থেকে আবদ্ধ করে রাখা যায়। ক্ষমতা প্রদশর্নের দুর্দান্ত কৌশল হলো নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নির্যাতন।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলে, নারীর প্রতি যে সহিংসতা প্রদর্শন করা হয়েছে অল্প কদিন আগে তা শুধু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষকামী সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনাটির ট্রমা, ক্ষতি ও ক্ষত ভুক্তভোগীরা কীভাবে কাটিযে উঠবেন সেটা আমার জানা নেই কিন্তু এর ফলাফল বা consequence যে সুদূরপ্রসারী তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এ ধরনের ঘটনা ঘটা মানে শুধু ব্যক্তি, পরিবার বা কমিউনিটির মনে হতাশা, ক্ষোভ বা ঘৃণারই জন্ম দেয় না পাশাপাশি যারা আক্রান্ত হলেন, সেই ব্যাক্তি নিজে, তার পরিবার এবং তার কমিউনিটির দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকবেন নানা ধরণের মানসিক সমস্যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো, depression, anxiety, loss and grief. সেখান থেকে আবার ডুবে যেতে পারেন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার (PTSD) পরিস্থিতির মধ্যে।
একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমি আপনি আমি কি এই দায় সহজে এড়াতে পারি? যারা নানা ধরণের মানসিক সমস্যা বা অসুখের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সামাজিক আচরণের মধ্যে নানারকম জটিলতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেইসব জটিলতা কি আমাকে আপনাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করবে না? এইসব মানসিক অসুস্থতা আসলে আমাদের কী দিচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
সাইকোলজিস্ট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপথেঘাটে যা ঘটে
পরবর্তী নিবন্ধমানোন্নয়নে সিপিডিএলের অভূতপূর্ব উদ্যোগ