নারীদের জন্য নার্গিস সাফিয়ের কারাজীবন

রিতু পারভী | শনিবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ২০২২, ইরান প্রজাতন্ত্রে বয়ে যায় এক মরুঝড়। পোশাকের বাড়াবাড়ি রকমের আইনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ইরানের নারীরা। ঘটনার সূত্রপাত মাসা আমিনি নামের এক ইরানি কন্যার কঠোর পোশাক রীতিতে সামান্য ঢিলে দেওয়াকে কেন্দ্র করে। নীতি পুলিশের বাড়াবাড়িতে প্রাণ যায় মাসার। প্রতিবাদের ঝড় উঠে সমগ্র ইরানে এবং বহির্বিশ্বে। মোর‌্যাল পুলিশিং এর বিরুদ্ধে, বাড়াবাড়ি রকম পোশাক আইনের বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ছিল প্রতিবাদ তেমন কঠোর ছিল এর দমন। প্রাণ যায় অসংখ্য তরুণীর, কারারুদ্ধ হয় অনেক নারী। এই প্রজাতন্ত্রের নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদীকে দেয়া হয় এবছরে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ২০২৩; যিনি জিন, জিয়ান, আজাদী আন্দোলনের সময় কারাগারের ভেতরে বন্দী নারীদের উপর যৌন ও শারীরিক অত্যাচারের চিত্র বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন।

মানবাধিকার কর্মী নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদী ইরানে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে নিরলস কাজ করে গেছেন। ২০০৩ সালে তিনি ডিফেন্ডারস অফ দ্য হিউম্যান রাইটস সেন্টারের উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যে সংস্থা নারী, বন্দী এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। এই সংস্থার প্রধান শিরিন এবাদি ২০০৩ সালে ইরানের প্রথম নাগরিক হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। একজন যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে ২০২৩ সালে নার্গিস সাফিয়ে অর্জন করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। ইরানে নারীদের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সবার জন্য মানবাধিকার ও মুক্তির সমর্থনে কাজ করার জন্য তাকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।

১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল ইরানের জাঞ্জানে জন্মগ্রহণ করেন নার্গিস সাফিয়ে। তাঁর বেড়ে উঠা ইরানের কোরভেহ, কারাজ এবং ওশনাভিয়েহ শহরে। ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন নার্গিস। বিভিন্ন সংবাদপত্রে নারীর অধিকার নিয়ে নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন ছাত্রাবস্থায়। পরবর্তীতে সংস্কারপন্থী সংবাদপত্রে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ‘দ্য রিফর্মস’, ‘দ্য স্ট্র্যাটিজি এন্ড দ্য ট্যাকটিকস’ নামে তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ বই আকারে প্রকাশিত হয়। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতির সাথে। রাজনৈতিক ছাত্রগোষ্ঠী তাশাক্কোল দানেশজুয়ি রোশানগারানএর সভায় গ্রেপ্তার হন দুইবার। রাজনীতির কারণে ত্যাগ করেন ভালোবাসার আগ্রহ পর্বতারোহণ।

মৃত্যুদণ্ড রদ করার পক্ষে প্রচারাভিযান চালানো একটি মানবাধিকার আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য’ ২০১০ সালে নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদীকে কারাবন্দী করা হয়। দীর্ঘ সময় পরে ২০১৬ সালে তাঁকে ১৬ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই তাঁকে ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০২২ সালে বিবিসি ১০০ প্রভাবশালী নারী তালিকায় নার্গিস সাফিয়ের নাম তালিকাবদ্ধ হয়।

নার্গিস সাফিয়ে ১৯৯৯ সালে সংস্কারপন্থী সাংবাদিক ও তাঁর সহকর্মী তাগি রাহমানিকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর পরই রহমানি প্রথমবারের মত গ্রেফতার হন। এরপর তিনি ১৪ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেন। ২০১২ সালে রহমানি দেশ ত্যাগ করে ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন এবং সেখান থেকেই মানবাধিকারের কাজ চালিয়ে যান। তখন থেকেই নার্গিসের দুই সন্তান নিয়ে তাঁর স্বামী রয়েছে দেশের বাইরে।

নার্গিসের দুই যমজ সন্তান ১৭ বছর বয়সী কন্যা কিয়ানা রহমানি এবং পুত্র আলি রহমানি মা’য়ের পক্ষ থেকে গত ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত এক আয়োজনে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে কারাগার থেকে পাঠানো মায়ের পত্র পাঠ করেন সন্তানেরা, যেখানে লেখা ছিল-‘ইরানের জনগণ দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে এই নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জয়ী হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি অবধারিত।’

৫১ বছর বয়সী নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদীকে তের বার গ্রেফতার করা হয় এবং পাঁচবার কারাদণ্ড দেয়া হয় যা সব মিলিয়ে ৩১ বছরের কারাদণ্ডের সাজা পান তিনি। কুখ্যাত এভিন কারাগারে ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারে’র জন্য সাজা ভুগছেন এখন তিনি। গত বছর কারাগার থেকে পাঠানো এক চিঠিতে কীভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কারাগারে নারীরা যৌন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন।

নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত রেইসঅ্যান্ডারসেন তাঁকে একজন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষামন্ত্রীর সাথে কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষদের সাথে মতবিনিময়
পরবর্তী নিবন্ধএকজন লড়াকু সৈনিক বেগম মুশতারী শফী